বেগম রোকেয়া: নারী মুক্তির অগ্রপথিক
বৃহস্পতিবার বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিন ৯ ডিসেম্বর। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের শৃঙ্খল থেকে নারীকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাওয়া এ মহীয়সী নারীকে আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে জাতি। এ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
প্রতি বছর বেশ ঘটা করেই এই দিনটিতে বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করা হলেও তার জন্মভূমিতে গড়ে ওঠা স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম আজও চালু হয়নি। সেইসঙ্গে বেগম রোকেয়ার পরিবারের বেহাত হয়ে যাওয়া প্রায় সাড়ে ৩শ বিঘা জমি উদ্ধারসহ রোকেয়ার দেহাবশেষ ফিরিয়ে এনে বাস্তুভিটায় সমাহিত করার দাবিও পূরণ হয়নি আজ অবধি।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্ন ছিল সমাজে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা আর অধিকার নিয়ে বাঁচবে। সেই স্বপ্নের কথাই তিনি লিখে গেছেন তার গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধগুলোতে। নারীশিক্ষার প্রসারে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, তাদের ক্ষমতায়ন, ভোটাধিকারের জন্য লড়াইটা এই বাংলায় রোকেয়াই শুরু করেছিলেন।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে এক জমিদার পরিবারে রোকেয়ার জন্ম হয়। রোকেয়া খাতুন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মিসেস আর এস হোসেন নামেও লিখতেন এবং পরিচিত ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতকে নারীরা যখন অবরোধবাসিনী, সেই সময়ে নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে তিনি আওয়াজ তুলেছেন।
বাবা জহির উদ্দিন মুহম্মদ আবুল আলী হায়দার সাবের, মা রাহাতুন্নেছা চৌধুরানী। বেগম রোকেয়ার ছিল দুই ভাই ও দুই বোন।
বড় ভাই ইবরাহিম সাবের ছিলেন একজন প্রগতিশীল মানুষ। অগোচরে মোমের আলোয় বেগম রোকেয়া ও আরেক বোন করিমনুন্নেছাকে বর্ণশিক্ষা দিতেন। আর রোকেয়ার ছিল জানার ও শিক্ষার অদম্য আগ্রহ।
১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদূর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। রোকেয়া পেলেন আরেক জন প্রগতিশীল মানুষের সাহচার্য। স্বামী সাখাওয়াত হোসেন বেগম রোকেয়ার লেখাপড়ার প্রতি অকুণ্ঠ আগ্রহ দেখে তাকে সাহায্য করতে লাগলেন বাংলা ও ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এবং তার লেখা-লেখিতে সাহায্য করতে লাগলেন।
এই শিক্ষাই তাকে সে সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন, শিক্ষাহীন নারী সমাজের মুক্তির কথা। নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে কী করে তাদের টেনে তোলা যায়, সে ভাবনা থাকতো তার মাথায়। আর তাই তো তিনি স্বপ্ন দেখলেন একটি স্কুলের। যেখানে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীরা লেখাপড়া শিখবে। আর তার এ স্বপ্নকে আরও বড় করে তোলেন তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন।
১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ। আর ১৯০৫ সালে রোকেয়া ইংরেজীতে লিখলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সুলতানাস ড্রিমস’। সাখাওয়াত হোসেন লেখাটি পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাকে উৎসাহ দেন লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করার জন্য।
১৯০৮ সালে সুলতানাস ড্রিমস বই আকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে বইটি বাংলায় ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে রূপান্তরিত হয়েও প্রকাশিত হয়। এই বইটিকে বিশ্বের নারীবাদি সাহিত্যে একটি মাইল ফলক হিসেবে গণ্য করা হয়। তার অন্যান্য গ্রন্থগুলো হলো ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচুর’, ‘পদ্মরাগ’।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, বেগম রোকেয়ার জমিগুলো বেদখল হয়ে আছে। কিছু জমিতে তার নামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ জমিগুলো উদ্ধারে আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
বেগম রোকেয়ার ভাই মসিহুজ্জামান সাবেরের মেয়ে পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষিকা রণজিনা সাবের বলেন, একটি দিনই মাত্র ঘটা করে বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করা হয়। বেগম রোকেয়ার প্রকৃত ইতিহাস ও কর্মময় জীবনী নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু করা উচিত।
১৯৩২ সালের এই দিনেই মারা যান তিনি। দিনটি রোকেয়া দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
দিবসটি পালনে রংপুরে নানা কর্মসূচি:
বেগম রোকেয়া দিবসে রংপুরে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। তার জন্মস্থান মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। আজ সকাল ১১টায় বেগম রোকেয়া স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দিবসের উদ্বোধন, সাড়ে ১১টায় আলোচনা সভা, সাড়ে ১২টায় নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ রোধ সম্পর্কিত সেমিনারে পুরষ্কার ও পদক বিতরণ, দুপুর ১টায় পায়রাবন্দ জামে মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, শেষে বিকেল সাড়ে ৩টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে এবার রোকেয়া মেলা হচ্ছে না। এ ছাড়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, বেগম রোকেয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও রংপুর রোকেয়া ফোরামসহ রংপুরের বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।