দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব
মুঘল আমলের নওয়াবি প্রথা শেষ হয়ে গেলেও বাছাই করা কিছু জমিদারদের নবাব/নওয়াব উপাধি দিত ব্রিটিশ সরকার। হিন্দু জমিদারদের ক্ষেত্রে ছিল মহারাজ, আর মুসলমান জমিদারদের ক্ষেত্রে নওয়াব। এটাই জমিদারির সর্বোচ্চ সম্মান হিসাবে বিবেচিত হত ঔপনিবেশিক শাসনামলে। বাংলাদেশের কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব ও নারীশিক্ষার পথিকৃৎ। তাঁর আগে বা পরে আর কেউ এমন সম্মানজনক উপাধি লাভ করেন নি। জমিদারি পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের অদম্য ইচ্ছায় শিক্ষিত হয়ে শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা-ও ইতিহাসে বিরল।
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে নওয়াব উপাধি দেওয়া সহজ ছিল না। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ও ঔপনিবেশিক ভারতের ক্ষমতা কাঠামো প্রত্যন্ত বাংলার একজন মুসলমান ও একজন নারীকে সম্মানিতা করতে আগ্রহী ছিল না। প্রশ্ন উঠেছিল, একজন মহিলাকে কী করে নওয়াব উপাধি দেওয়া যেতে পারে? শেষে ব্রিটিশ মহারানি ভিক্টোরিয়া ঠিক করলেন, তাঁকে 'বেগম' উপাধি দেওয়া হবে। কিন্তু আত্মসম্মানবোধের কারণে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন তিনি। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, প্রজারা তাঁকে 'বেগম' বলেই ডাকেন। কিন্তু তিনি এমন সম্মান চান, যা একজন পুরুষের সমকক্ষ। মহিলা বলেই পিছিয়ে থাকতে রাজি নন তিনি।
অবশেষে হার মানতে বাধ্য হয় সরকার ও সমাজের কর্তারা। ১৮৮৪ সালে রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে নওয়াব উপাধি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিতা করেন। ইতিহাসে নাম লিপিবদ্ধ করেন তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব রূপে।
নওয়াব ফয়জুন্নেসার জন্ম কুমিল্লা জেলার হোমনাবাদ পরগনার (বর্তমানে লাকসামের) অন্তর্গত পশ্চিমগাঁয়ে । তিনি ১৮৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা জমিদার আহমেদ আলী চৌধুরী আর মা আরাফান্নেসা চৌধুরাণী।
ফয়জুন্নেসা বাবার প্রথম কন্যাসন্তান। জমিদার বংশের সন্তান হিসেবে বেশ আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। মুঘল রাজত্বের উত্তরসূরী এই মহীয়সী নারীর ছিল দুই ভাই (এয়াকুব আলী চৌধুরী এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী) আর দু’বোন (লতিফুন্নেসা চৌধুরাণী এবং আমিরুন্নেসা চৌধুরাণী)।
ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় তাঁর প্রচুর আগ্রহ দেখে ফয়জুন্নেসার বাবা মেয়ের জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালন করে তাঁর জ্ঞানস্পৃহাকে আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলেন। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে ফয়জুন্নেসা খুব দ্রুতই কয়েকটি ভাষার উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত এ চারটি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ সহ ফয়জুন্নেসার এ প্রতিভা স্ফুরণে তাঁর শিক্ষক তাজউদ্দিনের অবদান অতুলনীয়।
সে সময়ের আরেক জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর সাথে ১৮৬০ সালে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের হয়নি। এক পর্যায়ে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। স্বামী বিচ্ছেদের পর তিনি সমাজ সংস্কার ও গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কথিত আছে, নওয়াব ফয়জুন্নেসা ১৮৭১ সালে বিয়ের সতের বছর পর জানতে পারেন তাঁর স্বামীর আরেকটি স্ত্রী আছে। তাই সতীন থেকে পৃথক থাকার জন্য তিনি তাঁর বিয়ের কাবিনের এক লক্ষ এক টাকা দিয়ে পশ্চিমগাও-এ সাড়ে তিন একর জমিতে একটা বাড়ি করেন। এটি নির্মাণ করতে তিন বছর সময় লেগেছিল।
শিক্ষার পাশাপাশি তিনি জমিদারি পরিচালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বুদ্ধির দীপ্ততা, বিচক্ষণতা আর কর্মদক্ষতায় অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন তিনি। ফলে ১৮৭৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মাতুল সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হয়ে সুদক্ষতার সঙ্গে সেসব পরিচালনা করেন।
কুমিল্লার হোমনাবাদ পরগনার জমিদার নবাব ফয়জুন্নেসা চিন্তা কাজ কর্মে ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাঁধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনোযোগ দিয়েছিলেন। একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারির কঠোর দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন। তিনি নির্ভীকভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন। তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেন আর নিজ জমিদারিটি পরিণত করেন 'ওয়াকফ' সম্পত্তি হিসেবে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব ফয়জুন্নেসা সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি জোর প্রচেষ্টা করেন। ১৮৭৩ সালে ('বেগম রোকেয়া'র জন্মের সাত বছর পূর্বেই) নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি মেয়েদের জন্য কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীন স্কুলগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। দেশে বিদেশে শিক্ষার প্রচারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। নওয়াব ফয়জুন্নেসা (পশ্চিমগাঁয়ে) একটি অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার ছাত্রদের অন্য একটি ছাত্রাবাসও ছিল। মাদ্রাসার ভালো ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে পরবর্তিকালে ফয়জুন্নেসার বংশধরগণ ১৯৪৩ সালে এটিকে উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত করেন। ১৯৬৫ সালে কলেজটি একটি ডিগ্রি কলেজে রূপান্তরিত হয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেসা ডিগ্রি কলেজ নামে আখ্যায়িত হয়। ১৯৮২ সালে কলেজটির সরকারিকরণ হয় এবং নাম হয় নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ। তাছাড়া তাঁর কন্যা বদরুন্নেসা পশ্চিমগাঁওয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য তিনি সব সময় উৎসাহিত করতেন। তিনি মেয়েদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর জমিদারির আয় থেকে মেয়েদের জন্য নির্মিত এ হোস্টেলের সব খরচ বহন করা হতো। মেয়েদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। তিনি পবিত্র মক্কা শরিফে 'মাদ্রাসা-ই-সওলাতিয়া ও ফোরকানিয়া' সহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর পরিমানে সহায়তা করেন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তিনি সমস্ত নারীর জন্যই চিন্তা ও কাজ করে গেছেন। জেলার উন্নয়নে কুমিল্লার তদানীন্তন প্রশাসক ডগলাস জমিদারদের কাছে ঋণ চাইলে তিনি তোড়াভরতি টাকা দান হিসাবে প্রেরণ করেন।
শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন 'ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল'। ১৮৯৩ সালে নওয়াব বাড়ির কাছেই তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেকগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানা এবং সড়ক নিমার্ণ করে তাঁর মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি নওয়াব বাড়ীর সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করার সময় তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি 'মুসাফিরখানা'ও প্রতিষ্ঠা করেন। নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি-বেসরকারি জনহিতকর কাজেও প্রচুর অর্থ দান করতেন।
রবীন্দ্রযুগে যে কয়জন বাংলা সাহিত্য সাধনা করে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন, নবাব ফয়জুন্নেসা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে নবাব ফয়জুন্নেসার নাম চিরস্মরণীয়। কলকাতার ঠাকুরবাড়ির 'সখী সমিতি'র সদস্যা ছিলেন তিনি। তিনি প্রথম মুসলিম গদ্য-পদ্যে লেখিকা ছিলেন। ১৮৭৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা গিরিশচন্দ্র মুদ্রণ যন্ত্র থেকে শ্রীমতি নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী রচিত সাহিত্য গ্রন্থ ‘রূপজালাল' প্রকাশিত হয়।
ব্রিটিশ অপশাসনের ফলে মুসলিম সমাজে কুসংস্কারের বেড়াজালে অবরোধবাসিনী হয়েও ফয়জুন্নেসা সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে একটি গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছেন। রূপজালাল ব্যতীত ফয়জুন্নেসা কর্তৃক দু'খানি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়-'সঙ্গীত লহরী' ও 'সঙ্গীত সার', এখন দুষ্প্রাপ্য। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর আগে তিনি তার সমস্ত ভূসম্পত্তি জাতির সেবায় দিয়ে যান।
২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী নিবাসের নামকরণ করা হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও জনহিতকর প্রচেষ্টা এখনও দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াবের স্মৃতি বহন করছে। ১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এ মহীয়সীর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দশগম্বুজ মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।