কেন্দ্রবিন্দুতে আজমেরি হক বাঁধন

  • সুমন ভট্টাচার্য
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আজমেরি হক বাঁধন

আজমেরি হক বাঁধন

রেহানা মারিয়ম নুর থেকে মুসকান জাবেরী। ঢাকা থেকে কলকাতা আপাতত আপ্লুত এক বাংলাদেশি অভিনেত্রীর অভিনীত বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে। কান এ তাঁর অভিনয় নিয়ে নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পর থেকে আজমেরি হক বাঁধনকে নিয়ে যে আগ্রহ এপার বাংলা দেখাচ্ছে, স্মরণাতীত কালের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি 'মুসলিম মহিলা'কে নিয়ে সেই উচ্ছ্বাস চোখে পড়েনি। এর মধ্যে কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের তরুণ পরিচালক মোহাম্মদ সাদের ছবি যদি কোনো পুরস্কার জিতে নেন, যার যথেষ্ট ইঙ্গিত পশ্চিমের চলচ্চিত্র সমালোচকরা ইতিমধ্যেই দিয়েছেন, তাহলে আজমেরি হক বাঁধন যে কত নতুন সিনেমার অফার পাবেন, বলা মুশকিল।

আজমেরি হক বাঁধন

আমি আজমেরি হক বাঁধন সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে অভিনেত্রীর আগে বাংলাদেশের 'মুসলিম মহিলা' শব্দবন্ধটি ইচ্ছে করে ব্যবহার করেছি। আমাদের এই ভট্টাচার্য, ব্যানার্জি, চ্যাটার্জি প্রভাবিত কলকাতার বাঙালি সমাজে একজন মুসলিম মহিলার স্বীকৃতি পেতে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়, তারপরে সেই মহিলা বাংলাদেশি হলে আরও কি কি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়, সেই সম্পর্কে একটু ধারণা আছে বলেই কথাগুলো লিখেছি। বাঁধন যে গুরুত্ব পাচ্ছেন, তসলিমা নাসরিনের পরে আমি কোনো বাংলাদেশি মহিলাকে এপার বাংলায় সেই গুরুত্ব পেতে দেখিনি। এবং ধর্মকে কেন্দ্র করে বিতর্ককে বাদ দিলে তসলিমা আর আজমেরি হক বাঁধনের মধ্যে আশ্চর্য মিল। দুজনেই ডাক্তার, ঘোষিত সিঙ্গল এবং পুরুষতন্ত্রকে 'বাপি বাড়ি যা' র মতো করে মাঠের বাইরে ফেলে দিতে অভ্যস্ত।

বিজ্ঞাপন
রেহানা মারিয়াম নুর সিনেমার পোস্টারে বাঁধন

বাংলাদেশের প্রথম কোনো সিনেমা হিসেবে সাদ পরিচালিত রেহানা মারিয়ম নুর কান ফেস্টিভাল এ দেখানো এবং সেই প্রদর্শনীর পরে দর্শকদের স্ট্যান্ডিং ওভেশন, তার সঙ্গে কানের প্রতিক্রিয়ায় আপ্লুত বাঁধনের কান্নায় ভেঙে পড়ার ছবি ভাইরাল হওয়া আজমেরি হক বাঁধনকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। এক সিঙ্গল মাদারের ভূমিকায় আরেক সিঙ্গল মাদারের অভিনয় চলচ্চিত্র বিশ্বকে যতটা আলোড়িত করেছে, তার তুলনা মেলা ভার। হলিউড রিপোর্টার বা স্ক্রিন এর উচ্ছ্বসিত রিভিউ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে যতটা সম্মানিত করেছে, ততটাই অভিনেত্রী হিসেবে, শুধুমাত্র অভিনেত্রী হিসেবে আজমেরি হক বাঁধনের জায়গাকে পোক্ত করেছে। এখানেও আমি ইচ্ছে করেই অভিনেত্রী শব্দটার উপরে যোগ দিলাম। কারণ কান চলচ্চিত্রোৎসবে এই বাঙালি অভিনেত্রীকে নিয়ে তুমুল চর্চা শুরু হওয়ার পর অন্য যে সব বাঙালি নায়িকারা হঠাৎই কানের সমুদ্রসৈকতে রোদ পোয়ানোর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন, তাঁদের খেয়াল রাখতে হবে তুলনাটা অভিনয় নিয়ে হচ্ছে, কে কি পোষাক পরলেন সেটা মুখ্য বিষয় নয়।

কান উৎসবে বাঁধন

রেহানা মারিয়ম নুর এ নামভূমিকায়, একজন ডিগ্ল্যামারাইজড, মাথায় স্কার্ফ বাঁধা খিটখিটে কিন্তু লড়াকু অধ্যাপকের চরিত্রে বাঁধনের ইনটেন্সড অভিনয় সকলের নজর কেড়েছে। তাই কনটেন্ট ইজ কিং, সমুদ্রতীরে কে কি পোশাক পরল বা পরেছিলেন, তা গৌণ। এই কনটেন্ট এর প্রশ্নেই বলতে হবে আজমেরি হক বাঁধন চমৎকার কথা বলেন, জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ। তিনি যে ডিভোর্সী, সিঙ্গল মাদার এবং তাঁর বয়স ৩৭ পেরিয়ে গিয়েছে, এই কথাগুলো এত জোরের সঙ্গে বলেন যে আশা জাগায়। বাংলাদেশের এই মডেল, অভিনেত্রী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রায় ক্রিস গেইলের ভঙ্গিতেই ব্যাট চালান। এবং এই সোজাসাপটা কথা বলার জন্যই কেন তিনি এতদিন ভাল কাজ পাননি বা বড় পরিচালকদের কাছ থেকে ডাক পাননি, তা বলে দিতে বাঁধনের কোনো দ্বিধা নেই।

বিজ্ঞাপন
 আজমেরি হক বাঁধন চমৎকার কথা বলেন, জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ

১৬ জুলাইয়ের পর থেকে আজমেরি হক বাঁধন কোন উচ্চতায় থাকতে পারেন, সেটা আন্দাজ করে নিয়ে হইচই প্ল্যাটফর্মের জন্য তৈরি করা 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' ওয়েব সিরিজের টিজার ছেড়ে দেওয়াটা প্রায় গাভাসকরের মতো টাইমিং সেন্স। মহাম্মদ নাজিমুদ্দিনের বহু প্রশংসিত থ্রিলারকে নিয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের তৈরি করা এই ওয়েব সিরিজ ও বহু আলোচিত। সেই ওয়েব সিরিজেরও কেন্দ্রীয় চরিত্র, অর্থাৎ মুসকান জাবেরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন।

'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' ওয়েব সিরিজ

রেহানা মারিয়ম নুর এর এক্কেবারে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত চরিত্রে, মুসকান জাবেরীর মতো কঠিন ভূমিকায় বাঁধনের লুক, টিজারে রাহুল বোসের মতো অভিনেতার মুখোমুখি হয়ে তাঁর হাসি, লাস্য তুমুল কৌতুহল তৈরি করেছে। গাভাসকরের টাইমসেন্স এবং বলকে কানেক্ট করার দক্ষতা যেমন অনেক শটকে নিশ্চিতভাবে বাউন্ডারিতে পাঠাতো, তেমনি 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' ওয়েব সিরিজ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে এইসময় গোটা বিশ্বের বাঙালিদের চোখ টানবে।

এবং বাংলাদেশের 'মুসলিম অভিনেত্রী', সিঙ্গল মাদার আজমেরি হক বাঁধন ডঙ্কা বাজিয়ে বৃহত্তর বাঙালি মননে জায়গা করে আরও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-ধন্য হবেন, এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া হবে। বাংলাদেশের সিনেমা আর বাংলাদেশের লেখকের লেখা থ্রিলারের উপর ভর করেই বিশ্বজয়ের পর ঢাকার মতো কলকাতার বাঙালি মনন তাঁর অনুগমন ছাড়া বিকল্প পথ খুঁজে পাবে না!

লেখক: সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক। কবি, কথাশিল্পী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।