কুষ্টিয়ায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচে মুগ্ধ দর্শক
-
-
|

কুষ্টিয়ায় গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য পুতুল নাচে মুগ্ধ দর্শকরা
পুতুল নাচ গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। গানের তালে তালে ঐতিহ্যবাহী ঘটনার সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র ও সুরের মূর্ছনায় পুতুলের নৃত্য। গ্রামীণ জনপদে শিশু-কিশোর ও সর্বস্তরের মানুষের বিনোদনের মাধ্যম। পুতুল খেলা শিশুদের কাছে উৎসবের মতো।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ আয়োজনে "লোকনাট্য সমারোহ" কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমি আঙ্গিনার মুক্তমঞ্চে দর্শকদের জন্য পুতুল নাচ দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম এ পুতুল নাচ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
এসময় তিনি বলেন, এক সময় রাত জেগে গ্রামের মানুষেরা ভিড় করতো এই পুতুল নাচ-গানের আসরে। পুতুল নাচের গল্পে তুলে ধরা হতো সে সময়ের মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখ–দুঃখ, রঙ্গরস, হাসি-ঠাট্টা ও নিত্যদিনের জীবনাচরণ। কাঠের পুতুল অথবা সোলা দিয়ে পুতুল তৈরি করে, সেটাতে রঙ তুলির আঁচড় দিয়ে, বিভিন্ন বর্ণিল সাজে সাজিয়ে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুতা দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে নাচায় এই পুতুল নাচের আসরে।
তিনি আরও বলেন, কুষ্টিয়া জনপদের বিনোদনে পুতুল নাচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। তবে কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী এই পুতুল নাচ আজ প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। তাই এই ঐতিহ্য পুতুল নাচ ধরে রাখতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পুতুলনাচের দৃশ্য যেন অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
পুতুলের কিচিরমিচির শব্দে কিছু কথা বোঝা যাচ্ছে, তবে হারমোনিয়াম আর সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে শিল্পী এবং সেই পুতুলের কণ্ঠনালীকে তুলে সুর মেলাচ্ছিলেন আবদুল কুদ্দুস।
বেশ কিছু মেয়ে পুতুলের সাজসজ্জার পাশাপাশি রাজা রানী, চৌকিদার, দাসী, পাইক পেয়াদা, সাপুড়িয়াসহ কুষ্টিয়ার বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহয়ের বাউলশিল্পীদের একটি দলের সমন্বয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো পুতুল নাচের।
উপস্থিত দর্শকরা উপভোগ করছিলেন এই পুতুল নাচের। তবে উপস্থিত দর্শকরা পুতুল নাচ দেখে মুগ্ধ তা প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি।
কুষ্টিয়ার ‘মনহারা’ পুতুল নাচের যৌবনে দীপ্তমান কদর থাকলেও আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে আজো বিশেষ কোন আয়োজন ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাহক হিসাবে প্রদীপের মতো টিপ টিপ করে বেঁচে আছে দেশের বিখ্যাত পুতুল নাচ ‘মনহারা’ পুতুল নাচ। এই দলের পুতুল নাচ দেখলে সত্যিই যে কারও মন হারিয়ে যায়।
শিল্পকলা একাডেমিতেই কথা হয় আব্দুল কুদ্দুসের সঙ্গে।
আব্দুস কুদ্দুস বলেন, ১৯৬৫ সালে তখন আমার বয়স ৯-১০ বছর। আমার বাবা খুবই সৌখিন মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন গান-বাজনা শেখানোর জন্য পুতুল নাচের ‘মনহারা’ পুতুল নাচের দলে নিয়ে যায়। সেখানে শুকচান মাল নামের একজন ওস্তাদের কাছে নিয়ে যায় আমাকে। আমি তখন দেখতে খুব সুন্দর ছিলাম। সেখানে মাস কয়েক পুতুল নাচের বিভিন্ন গান শিখি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে পুতুলের সঙ্গে নাচ-গান করি। এরই মধ্যে ওস্তাদের প্রিয় হয়ে উঠি। প্রায় ১৬ বছর আমি পুতুল নাচের আসরে পুতুলের সাথে মেয়ে সেজে গান করি। ৪-৫ দিন অনুষ্ঠান করলে আমি ৫০-১০০ টাকা পেতাম।
‘১৯৭২ সালে মনহারা পুতুল নাচের দলটির দায়িত্ব আমি পাই। তখনো ওস্তাদ আমার সাথে থাকতেন। তারপর ওস্তাদ শুকচান অসুস্থ হয়ে মারা যান। দলের প্রায় দুর্দিন নেমে আসে। আমাদের পুতুল নাচের দলে ছিল ১৪ জন সদস্য। এর মধ্যে ১০ জন গানের তালে পুতুলকে পরিচালনা করতো। বাকিরা বাদ্যযন্ত্র বাজাতো আর গান গাইতো। ১৯৭৫ সালে আমি হারমনি বাজানোর প্রশিক্ষণ নেয় কুষ্টিয়া শিল্পকলা থেকে। তারপরে দলের দুর্দিন প্রায় কাটিয়ে উঠি। একটা অনুষ্ঠানে গেলে আরেকটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেতাম। বেশ ভালোই চলছিল আমাদের পুতুল নাচ। কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু অঞ্চলে পুতুল নাচ করে বেশ সুনাম অর্জন করি।’ আমি যতদিন বেঁচে আছি এই পুতুলের সাথেই জীবনটা কাটিয়ে দেবো। মানুষের মনে একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করবো।
দর্শক আরশীজামান বলেন, এই প্রথমবারের মতো পুতুল নাচ দেখলাম। বাচ্চাদের সাথে নিয়ে এসেছিলাম বিলুপ্তির পথে যাওয়া এই পুতুল নাচ দেখে আমরা অভিভূত।
সাংস্কৃতিক কর্মী কনক চৌধুরী বলেন, পুতুল নাচ বাংলার মানুষের প্রাচীন একটি ঐতিহ্য। এই পুতুল তৈরি করতে যেমন অর্থের প্রয়োজন তেমনি এই নাচ-গান পরিচালনার জন্যেও অর্থের প্রয়োজন। তবে বর্তমানে অশ্লীল নাচ গানের কারণে এই গান করতে নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়।’ জেলা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এই বিলুপ্তির পথে পুতুল নাচকে যেভাবে শহরের মানুষের জন্য প্রদর্শন করা হয়েছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। আগামী প্রজন্মের জন্য এই পুতুল নাচ ঐতিহ্য বহন করবে বলে আমি মনে করি।
জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সুজন রহমান বলেন, মিরপুর উপজেলার ‘মনহারা’ পুতুল নাচ জেলার মধ্যে তথা সারাদেশেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আব্দুস কুদ্দুস তিনি এই দলটিকে ধরে রেখেছেন। বিভিন্ন স্থানে গ্রামের মানুষের মাঝে পুতুল নাচের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিনোদন দিচ্ছেন। এই পুতুল নাচ যেন আব্দুল কুদ্দুস টিকিয়ে রাখতে পারে এজন্য শিল্পকলা থেকে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।