স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসার সরকারি হাসপাতাল নিউরোসায়েন্সেস
হাসপাতালের মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পথে বামে পরিষ্কার সাজানো ফুলের বাগান। চারদিক বেশ পরিপাটি। হাসপাতালে ঢোকার পথটিও বেশ পরিচ্ছন্ন। বামদিকে একটি নির্মাণাধীন ভবন। পাশে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট নতুন ভবনটিও হতে চলেছে এই হাসপাতালের অংশ। মূল ভবনে ঢুকতেই সিঁড়ির বাম পাশে টিকিট কাউন্টার। পাশে ফার্মেসি। সেখান থেকে দেওয়া হচ্ছ, সরকারি বিনামূল্যের ওষুধ। কাউন্টারে এসে রোগীদের যেন হয়রানি শিকার না হতে হয়, সে জন্য আছে বিশাল বোর্ডে সরকারি ওষুধের তালিকা।
এছাড়াও ইমার্জেন্সিতে আসা রোগীদের জন্য স্ট্রেচার ও হাঁটাচলা করতে না পারা রোগীদের জন্য রাখা আছে পর্যাপ্ত হুইল চেয়ার। হাসপাতালের লবি থেকে হাতের বামে ইমার্জেন্সি ও ডানে বহিঃবিভাগ। ওদিকটায় একটু বেশি ভিড়। তবে চারদিকটাই সাজানো গোছানো ও সুন্দর।
অপরিচ্ছন্ন, অপরিষ্কার আর নোংরা পরিবেশই যেন সরকারি হাসপাতালের নিয়মিত চিত্র। তারই বিপরীতে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে, উন্নত মেশিনারিজ আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবামূলক আচরণে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল।
সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে কম খরচে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়ায় খুশি সেবা নিতে আসা রোগী ও তার স্বজনেরাও। পুরো হাসপাতাল সিসি ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে থাকায় নেই দালালের উৎপাতও। ওয়ার্ড বয়, স্ট্রেচার বয় ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহারেও আছে সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। কম খরচে এমন উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারায় মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই সুনাম কুড়িয়েছে দেশ জুড়ে এই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল।
এমন নাম কুড়িয়েও শয্যা সংখ্যার অপ্রতুলতায় ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে অনেককেই। তবে আশার কথা হলো, ৪শ ৫০ শয্যা থেকে ৯শ ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের কাজ এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। পুরোপুরি কাজ শেষ হলে সে আক্ষেপ অনেকটাই ঘুচবে বলে আশা করছেন সবাই।
ইতিমধ্যেই হাসপাতালটিতে চালু হয়েছে, অত্যাধুনিক ১০০ শয্যা বিশিষ্ট স্ট্রোক ইউনিট। জানা যায়, অত্যাধুনিক এই স্ট্রোক ইউনিটে স্ট্রোক হওয়ার চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে নিয়ে আসতে পারলে লাঘব করা যাবে পঙ্গুত্বসহ নানা শারীরিক সমস্যা। এছাড়াও রয়েছে মাথাব্যথা, এপিলেপসি, মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার ক্লিনিক। নিউরোলোজি, নিউরোসার্জারি, পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি, পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জারি, নিউরোফিজিওলজি, নিউরোইন্টারভেনশন, নিউরোরিহাবিলিটেশন, নিউরোরেডিওলজি, নিউরোপ্যাথোলজি, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এবং মেডিসিনসহ আরও বেশ কিছু বিভাগ। আছে অপারেশন থিয়েটার, ক্যাথ ল্যাব, ল্যাবরেটরি সার্ভিস ও আইসিইউর মতো জরুরি প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার ব্যবস্থাও।
সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আদলে গড়ে তোলা হাসপাতালটি চালু হয়, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে নির্মিত এই হাসপাতালের প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০০৩ সালে। তবে দীর্ঘদিন পরিকল্পনায় আটকে থাকার পর ২০০৯ সালে শুরু হয়, হাসপাতাল নির্মাণ কার্যক্রম। দেশের বৃহত্তম নিউরোলজি ও নিউরো সার্জারিবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবার এই হাসপাতালটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২শ ৩১ কোটি টাকা। চিকিৎসার পাশাপাশি প্রতিবছর নিউরোলজি ও নিউরো সার্জারিবিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
সরেজমিন হাসপাতালটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকগুলো। হাসপাতালের লবি থেকে হাতের বামে ইমার্জেন্সি ও ডানে বহিঃবিভাগ। এখানে মানুষের জটলাটা একটু বেশি। জানা গেল, কয়েক হাজার রোগীর তুলনায় বহিঃবিভাগ ছোট হওয়ায় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে রোগীদের থাকতে হয় দীর্ঘ অপেক্ষায়। এছাড়াও নেই পর্যাপ্ত বসার স্থান। সে কারণে অসুস্থ শরীর নিয়েও বাধ্য হয়ে সেবা প্রত্যাশীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
হাসপাতালটিতে আসা সেবাপ্রত্যাশীদের অনেকেই বার্তা২৪.কম প্রতিবেদককে জানান, তাদের সন্তুষ্টির কথা। হাসপাতালের পরিবেশ, সেবার মান ও উন্নত সরঞ্জামাদি থাকায় অনেকটায় নিশ্চিন্তে সেবা নিতে পারেন বলে মন্তব্য করেন অনেকে। রোগী ও তাদের স্বজনরা বলেন, সরকারি হাসপাতালে এমন উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা কখনো কল্পনাও করতে পারেননি তারা। এখানকার খাবারের মানও অনেক ভালো। রোগীর সেবায় থাকা নার্স ও ওয়ার্ডবয়রাও রোগীর সেবাযত্নে কোনো ত্রুটি রাখেন না। অনেক বেসরকারি নামিদামি হাসপাতালের চেয়েও এখানকার চিকিৎসা সেবা উন্নত বলেই মনে হয় আমাদের, বলছিলেন একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
বাগেরহাট থেকে স্ট্রোক করা মা-কে নিয়ে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে এসেছেন নজরুল মিয়া। জানালেন, চারদিন আগে হাঁটতে গিয়ে বাড়ির উঠানেই পড়ে যান তার মা। পরে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে রেফার করেন ঢাকার এই হাসপাতালে। এখানে নিয়ে আসার পর থেকে গত চারদিনে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন তার মা। দুই-একদিনের মধ্যে ছুটিও দিয়ে দিতে পারে বলে জানান তিনি।
বার্তা২৪.কমকে নজরুল মিয়া বলেন, কখনো ভাবিনি সরকারি হাসপাতালে এমন সেবা পাবো। হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে কোথাও কোনো দালাল নেই। কর্মচারীদের ব্যবহারও ছিল ভালো। ওয়ার্ডে থাকার জন্যও আমাদের কিছু নিয়ে আসতে হয়নি বাইরে থেকে। আমার মায়ের দেখভালের জন্যও আমাকে থাকতে হয়নি। তারাই দায়িত্ব নিয়ে আমার মাকে সুস্থ করে তুলেছেন।
পটুয়াখালী থেকে শাশুড়িকে নিয়ে এসেছেন বিল্লাল হোসেন। সিট না পাওয়ায় কিছুটা হতাশা প্রকাশ করলেও হাসপাতালের পরিবেশ ও ডাক্তারদের ব্যবহারে অনেকটাই সন্তুষ্ট জানিয়ে বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, ‘আমি তো নিউরোসাইন্সের কথা আগেও শুনছি। এখানকার ডাক্তার নাকি অনেক ভালো। ডাক্তার ভালোই। চিকিৎসাও তো ভালোই হইতাছে। শাশুড়ি স্ট্রোক করছে। হেরে নিয়া আইছি। এইখানকার ডাক্তার দেখছে। দেইখা কইছে, ভর্তি করাইতে হইবো। কিন্তু আজকে নাকি সিট খালি নাই। কইছে কালকে আইতে।‘
হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীদের বক্তব্যই ছিল এমন। সিট না-পাওয়া ও লম্বা সিরিয়াল থাকায় কিছুটা হতাশা প্রকাশ করলেও হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থায় সন্তুষ্টির কথায় জানান তারা। বিনামূল্যে ঔষধ, কম খরচে উন্নত টেস্টের ব্যবস্থা ও ওয়ার্ড-কেবিনের পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতায় তাদের সন্তুষ্টির মূল কারণ বলেও জানান সেবাপ্রত্যাশীরা।
তবে ৫০০ শয্যার বর্ধিতাংশ প্রস্তুত হয়ে গেলে সে সংকটও কাটবে, এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সবার।