শুনানিতে তোপের মুখে পেট্রোবাংলা ও বিইআরসি
-
-
|

ছবি: সংগৃহীত
গ্যাসের দাম বাড়ানোর শুনানিতে ক্যাব, ব্যবসায়ী সংগঠন শিল্প মালিকদের তোপের মুখে পড়ে বিইআরসি, পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানি কর্মকর্তারা। প্রস্তাবকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে শুনানি করায় বিইআরসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
ক্যাবের পক্ষ থেকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব ভয়ঙ্কর গণবিরোধী। কমিশনের এই শুনানি গ্রহণ করা যৌক্তিক হয় নি। তাদের উচিত ছিল কমিশনের বৈঠকেই এই প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়া।
তিনি বলেন, এখানে যেভাবে আমদানির কথা বলা হয়েছে, এইভাবে আমদানি করে করে শুধু জ্বালানি নয়, সব পণ্য আমদানি করে দেশটা আমদানি নির্ভর করে ফেলা হচ্ছে। এই প্রস্তাবের উপর কোনো শুনানি হতে পারে না। এটি বন্ধ করতে হবে। আমরা অনুরোধ করবো এই শুনানি এখনই বাতিল করে দেওয়া হোক।
বক্তব্য শেষে প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি শুনানি বর্জণের ঘোষণা দিয়ে বেরিয়ে যান। তিনি যাওয়ার সময় বলেন, আন্দোলন করতে বাধ্য করবেন না। আন্দোলন করতে হলে তার ফল ভালো হবে।
শিল্প কারখানার বয়লার ও শিল্প কারখানার জেনারেটরে (ক্যাপটিভ) সরবরাহ করা গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান গ্রাহকদের দর অপরিবর্তিত থাকার কথা বলা হলেও অনুমোদিত লোডের অধিক ব্যবহারের অংশ এবং প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের (ইতোমধ্যে অনুমোদিত) গ্যাসের বিল অর্ধেক বিল বিদ্যমান দরে, অর্ধেক ৭৫.৭২ টাকা নির্ধারণ চায় পেট্রোবাংলা।
শুনানি শেষে বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, যারা বক্তব্য দিয়েছেন এবং যারা দেন নি এমনকি কোম্পানির পক্ষ থেকেও শুনানি পরবর্তী লিখিত মতামত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারো কোন মতামত থাকলে আগামী ৭ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে জমা দেওয়া যাবে। আমরা সকল পক্ষের মতামত শুনলাম, সবকিছু বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, হ্যাঁ এ কথা সঠিক শিল্পে দুই ধরনের দর বৈষম্য তৈরি হতে পারে। অনেকেই শুনানি বন্ধের দাবি করেছিলেন, আমাদের বক্তব্য হচ্ছে আজকে সকল পক্ষের কথা শুনতে পারলাম। সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিয়াম অডিটরিয়ামে শুনানি শুরু হয়। প্রথমে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে এরপর ৬টি বিতরণ কোম্পানি তাদের উপস্থাপনা তুলে ধরেন। দুপুর ১২ টায় শুরু হয় জেরাপর্ব। প্রথমেই জেরা করতে আসেন ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড এম শামসুল আলম। তিনি প্রায় ৫০ মিনিট কথা বলেন। তার বক্তব্যের পর সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বক্তব্য দিতে আসেন।
সঙ্গে সঙ্গে কিছু শিক্ষার্থী ও শিল্প মালিক প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। শিক্ষার্থীরা শুনানি বন্ধের দাবী জানিয়ে শ্লোগান দিতে থাকেন। শুনানীতে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী, ক্যাবের প্রতিনিধি এবং অন্য সংগঠনের প্রতিনিধিরা শুনানী বন্ধের দাবিতে শ্লোগান দিতে শুরু করেন। 'প্রহসনের শুনানি বন্ধ করো, করতে হবে, মানি না, মানবো না। ' এই শ্লোগান দিতে শুরু করেন।
বিইআরসি চেয়ারম্যান বারবার তাদের থামানোর চেষ্টা করলেও হট্টগোল চলতে থাকে। কয়েক মিনিট এভাবে চলার পর নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগেই মধ্যহ্ন বিরতীর ঘোষণা দিয়ে হল রুম থেকে বের হয়ে যান চেয়ারম্যান। মধ্যহ্ন বিরতীর পর যথারীতি ২ টায় ফের শুনানি শুরু হয়।
বিকেএমইএ সভাপতি হাতেম আলী বলেন, অবান্তর অযৌক্তিক প্রস্তাবের শুনানি বন্ধ করার বিনীত অনুরোধ করছি। ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা হলে নতুন শিল্প আসবে না, শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। আশা করি শিল্পখাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করবেন না।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেছেন, আমার মনে হয় না পেশাদার কোন লোক এই প্রস্তাব দিতে পারে। পেছনে কোন অপেশাদার লোক এবং স্বার্থান্বেষী গ্রুপ কাজ করছে দেশের শিল্প বন্ধ করার জন্য। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের শিল্পখাত ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশ পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির উদ্দিন বলেন, এভাবে ৩০ টাকার গ্যাসের দাম ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়ে আমরা কি মেসেস দিচ্ছি দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। আপনারা কি বলতে চাচ্ছেন স্টপ শিল্পায়ন, নতুন শিল্পের দরকার নেই। দয়া করে গ্যাসের দাম বাড়াবেন না। এটার মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
ব্যারিস্টার তামিম হোসেন বলেন, শিল্পে দুই ধরণের গ্যাসের দাম করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিইআরসি আইন অুনযায়ী দুই ধরণের ট্যারিফ নির্ধারণের সুযোগ নেই। এই প্রস্তাব অগ্রহযোগ্য এবং বেআইনী। সংবিধানে সবার অধিকার সমান করা হয়েছে। সে হিসেবে সাংবিধান পরিপন্থী এই প্রস্তাব।
বিটিএমইএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, আমরা বিনিয়োগ করে ফেঁসে গেছি। ব্যবসা বন্ধ করতে পারছি না, ব্যাংক ঋণ রয়েছে বলে। না হলে অনেক আগেই বন্ধ করে দিতাম। এখন যে ৩০ টাকা দিচ্ছি সেটাই অনেক বেশি। আমরা গ্যাস পাচ্ছি না, আর আপনারা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আপনারা ব্যবসাটা কি ভারতের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন! দয়া করে শিল্পকে ভারতের হাতে তুলে দিবেন না।
বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন এন্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স এসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর বলেন, দফায় দফায় গ্যাসের দাম বেড়েছে কিন্তু আমাদের কমিশন বাড়েনি। এতে করে আমাদের ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলাম, তারা ২০১৭ সালে বিইআরসিকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু বিইআরসির পক্ষ থেকে এতোদিনেও কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। সদস্যদের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে আমরা রমজান মাস বলে সময় দিচ্ছি। কিন্তু ঈদের পরে ধর্মঘটে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি তার মূল্যায়ন রিপোর্টে বলেছে, এলএনজি আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ আবার ভোক্তা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মুসক রয়েছে। দুইবার মুসকের বিষয়টি সমাধান করা গেলে এলএনজি আমদানি পর্যায়ে ঘনমিটার প্রতি ৭.৩৪ টাকা কমে আসে। এতে করে ঘাটতি কমে আসবে।
নতুন ট্যারিফ নির্ধারণ হলে ওই দুই শ্রেণির ভোক্তারা নতুন সংযোগ গ্রহণে যদি আগ্রহী না হয়, অথবা প্রতিশ্রুত গ্রাহক অনুমোদিত লোডের অর্ধেকের বেশি ব্যবহার না করে, বিদ্যমান গ্রাহকরা যদি অুনমোদিত লোডের বেশি ব্যবহার না করে তাহলে পেট্রোবাংলার কাঙ্খিত রাজস্ব অর্জিত হবে না বলে মন্তব্য করেছে টেকনিক্যাল কমিটি।
গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও সংগঠনগুলো সকলেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। তারা অবিলম্বে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবী জানিয়েছেন। ওই প্রস্তাব অনুমোদন হলে শিল্পায়ন বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা আদালতে মামলা ঠুকে দেওয়ারও হুমকি দেন।
শুনানি গ্রহণ করেন বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ, সদস্য মিজানুর রহমান, ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, মোঃ আব্দুর রাজ্জাক ও শাহীদ সারোয়ার।