তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির (সম্ভাব্যতা যাচাই) বাধ্যবাধকতা থেকেই গেলো। জ্বালানি খাত পিছিয়ে থাকার অন্যতম বাঁধা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডিকে। কার স্বার্থে বহাল রাখা হলো, এতে কারা লাভবান হবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন!
ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি একদিকে যেমন সময়ক্ষেপণ হয়, তেমনি কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হয়। বিগত সরকারের সময়ে অনেক সমলোচনার পর তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। অনুমোদন প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত ধাপে ছিল। কাজটিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার।
তার যুক্তি ছিল, কূপ খনন করলে গ্যাস পেতেও পারি, আবার নাও পেতে পারি। গ্যাস পেলে অনেক মুনাফা, আর না পেলে পুরো বিনিয়োগ জিরো, এখানে আবার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অর্থ কী? এটাতো ব্রিজ-কালভার্ট নয় যে সম্ভাব্যতা যাচাই করবো। এখান থেকে রিটার্ন আসতে পারে, আবার নাও আসতে পারে। আমরা যখন কূপ খননের জায়গা চূড়ান্ত করি তার আগে সিসমিক সার্ভেসহ অনেক কাজ করতে হয়, এটাওতো এক ধরণের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি। তাহলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কেনো সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে।
কনসালটেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া খুবই দীর্ঘ প্রক্রিয়া, আবার অনেক ব্যয়বহুল। কনসালটেন্টের মাধ্যমে যে কাজ ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ হবে। একইকাজ পেট্রোবাংলা নামমাত্র মূল্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় সম্পন্ন করতে পারে। কনসালটেন্ট যে কাজ করতে কয়েকমাস সময় নেয়, সেই কাজ ১৫ দিনের মধ্যে শেষ করতে পারে বাপেক্স-পেট্রোবাংলা। কনসালটেন্ট যে কাজ করে, সেটাও পেট্রোবাংলার তথ্যের উপর নির্ভর করে এবং তাদের লোকজনের সহায়তা নিয়ে। মাঝ থেকে একটি গ্রুপ কিছু টাকা নিয়ে চলে যায়। অতীতে অনেক কূপ ব্যর্থ হয়েছে ভবিষ্যতেও হতে পারে এটাই নিয়তি। ১০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ১টিতে গ্যাস পেলে বাণিজ্যিকভাবে সফল বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে এই প্রাপ্তির হার তিন অনুপাত এক।
পেট্রোবাংলার একটি সূত্র জানিয়েছে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অনুসন্ধান কূপ, ২ডি, ৩ডির ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদন পেলেই চূড়ান্ত হয়ে যেতো। কিন্তু অনুমোদন না দিয়ে বাতিল করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বাতিলের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি থেকে অব্যাহতির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। ৫০ কোটি টাকার উপরে ডিপিপি হলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করতে হবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বর্তমান সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামও অনেক চেষ্টা করেছিলেন ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য। পরিকল্পনা বিভাগের সচিব বরাবরে একটি পত্র দিয়েছিলেন।
ওই চিঠিতে ডিপিপি প্রণয়নে পরিকল্পনা বিভাগ কর্তৃক জুন ২০২২ এ জারিকৃত উল্লেখিত ৫০ কোটি টাকার উর্ব্ধে বিনিয়োগ প্রকল্প তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি সম্পাদন করা থেকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে অব্যাহতি প্রদানের অনুরোধ করেন।
ওই চিঠিতে তিনি লেখেন ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি সম্পাদনের বাধ্যবাধকতার অব্যাহতি চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে ইতোপূর্বে প্রেরিত পত্রটি পুনরায় পরিকল্পনা কমিশনে বিবেচনার জন্য। তিনি লিখেছেন, দ্রুততম সময়ে ও অর্থসাশ্রয় করে বাপেক্সের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনপূর্বক অতিরিক্ত অর্থব্যয় ব্যতিরেকে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করা সম্ভব। গুরুত্বপুর্ণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন ক্ষেত্রে অনেকগুলো ধাপ অনুসরণ করতে হয়। এ সকল কার্যক্রম অনুসরণ করে চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন পেতে ৬ থেকে ১২ মাস সময় প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি প্রতিটি প্রকল্পে সমীক্ষা বাবদ ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়।
ডিপিপি জটিলতা কেমন প্রভাব ফেলে তার এই নজীর হতে পারে পাবনার মোবারকপুর। মোবারকপুরে কূপ খনন করতে ১০ হাজার পিএসআই (চাপ বর্গ ইঞ্চি) ব্লোআউট কন্ট্রোল প্রিভেন্টার (বিওপি) নিয়ে কাজ শুরু করে। কূপ খননের সময় দেখা গেলো ভেতরের প্রেসার ১২ হাজার পিএসআই। চাপ আরও বাড়ন্ত ছিল, বাধ্য হয়ে কাজ বন্ধ রেখে ডিপিপি সংশোধন করতে হয়। যেহেতু ডিপিপিতে ১৫ হাজার বিওপির অর্থের সংস্থান ছিল না। আরডিপিপি অনুমোদন করতে এতে লম্বা সময় চলে যায়। এখান থেকেও শিক্ষা নেয় নি বাংলাদেশ।
এ রকম অনেক জটিলতা তৈরি হতে পারে, যা আগে থেকে অনুমান করা খুবই কঠিন। এমনটি কতগুলো টুলস কিনতে হয়, সেগুলো পিপিআর এর তালিকা বর্হিভূত, দরও অজানা। সে ক্ষেত্রে কিনতে গেলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, চাহিদাপত্র তৈরি, স্টোর ক্লিয়ারেন্স, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন কমিটি, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে সম্ভাব্য দর চাওয়া, এরপর ক্ষেত্রবিশেষে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় অনুমোদন। এসব করতে প্রায় ২ বছরের বেশি সময় চলে যায়। এমন সব জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে। অথচ কূপ অরক্ষিত রেখে ফাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন,তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি অনেক সময় কাজ ব্যহত করে। আমি অনেক কৌশলে কাজ করতাম। অনুসন্ধান কূপের ক্ষেত্রে বলা হতো জমি অধিগ্রহণ ব্যতিরেকে। আমি তখন শর্ত যুক্ত করলাম গ্যাস পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ করবো। শাহবাজপুর ২ নম্বর খননের সময় রাস্তা ও কূপের জন্য ৭.৫ একর জমি অস্থায়ীভাবে অধিগ্রহণ করি। গ্যাস পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ীভাবে অধিগ্রহণ করা হয়। ডিপিপিতে সেভাবে শর্ত যুক্ত করা হতো।
তিনি বলেন, পাবনার ক্ষেত্রে দূরদর্শীতার অভাব ছিল, সেখানে জিওফিজিক্যাল ইতিহাসের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। আমাদের মধ্যে অনেকের স্বচ্ছতা নেই, অনেকের ধারণা নেই, ডিপিপিতে ঝূঁকির বিষয়টি রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে পিডিকে চৌকষ ও ডিপ্লোম্যাটিক হওয়া উচিত। আমার সময়ে আমি কিছু বাড়তি অর্থ রাখতাম, প্রয়োজনে না হলে সেই টাকা ফেরৎ দেওয়া হতো।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জ্বালানি খাত যে একটি বিশেষায়িত খাত সেটা মাথায় নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি কেউই। কারো কারো মধ্যে দূরভিসন্ধী কাজ করে। দেশে ক্রাইসিস হলে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে পারেন, বিদেশি ঠিকাদার হায়ার করতে পারেন। এতে তাদের কমিশন বাণিজ্য হয়, যা দেশীয় কোম্পানি কূপ খনন করে গ্যাস উত্তোলন করলে হয় না।
বাপেক্সের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির ক্ষেত্রে সাবেক আমলাদের একটি প্রতিষ্ঠান (আইআইএফসি) কাজ করে থাকে। যারা এখন কাজ করে শেষ করতে পারছে না। শীর্ষস্থানীয় আমলাদের সঙ্গে ওই কোম্পানির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। তারা এখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারেন। কারণ ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি বন্ধ হয়ে গেলে তাদের আয় রোজগার কমে যাবে। এখন তারা একেকটি প্রজেক্টের জন্য ৪০ লাখ টাকা করে নিচ্ছে। আমাদের ডাটা নিয়েই আমাদের লোকজনেই হয়তো কাজ করছে, তারা শুধু সিল ছাপ্পর দিয়ে দিচ্ছে। আর পেট্রোবাংলার চাওয়া ছিল, আমরা নিজেদের লোকজন, নিজেদের তথ্য এবং বুয়েটের শিক্ষকদের নিয়ে সভা করে চূড়ান্ত করা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই খাতকে বিশেষভাবে নজর না দেওয়ায় আজকে ভয়াবহ গ্যাস সংকট। ব্রিজ, রোড তৈরির মতো করে বিবেচনা করলে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর অনুসন্ধানে গতি আনা না গেলে গ্যাস সংকট দূর করা সম্ভব না।