নওগাঁয় গবাদিপশুর ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ’র প্রাদুর্ভাবে আতঙ্কে খামারিরা
-
-
|

গবাদিপশুর ভাইরাসজনিত চর্মরোগ ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ’ , ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
নওগাঁর মহাদেবপুরে গবাদিপশুর ভাইরাসজনিত চর্মরোগ ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ’ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। উপজেলার বসতবাড়ি ও খামারে লালন-পালন করা প্রায় দুই হাজার গরু এরই মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। পশু চিকিৎসক ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর চিকিৎসা ব্যবস্থা করলেও সুনির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন না থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় খামারিরা। তবে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা খামারিদের আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের খামারিদের সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, গত একমাস আগে গবাদিপশু এমন রোগে আক্রান্ত হতে শুরু হয়। প্রথমে গরুর চামড়ার উপরিভাগে টিউমারের মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। পরে তা মানুষের শরীরে হওয়া পক্সের মতো গুটি গুটি হয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। দু’তিনদিনের মধ্যে প্রাণীর সারা শরীরে তা বড় বড় হয়ে ফেটে ঘা-তে পরিণত হচ্ছে।
পশু চিকিৎসকদের ডাকা হলে- তারা গরুর শরীরে ১০৪ থেকে ১০৬ ডিগ্রি জ্বর আছে বলে জানাচ্ছে। রোগাক্রান্ত গরু কোনো খাবার মুখে নিচ্ছে না। অনেক গরুর বুকের নিচে হওয়া গুটিতে পানি জমে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। পরে সেখান থেকে খসে পড়ছে মাংস।
সাগর হোসেন নামে এক খামারি বলেন, সপ্তাহখানেক আগে আমার খামারের দুটো গরু অসুস্থ হয়। পরে পশু চিকিৎসক ডাকা হলে তারা ইনজেকশন ও ঔষধ দিয়েছে। তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি। গরুর শরীরে হওয়া গুটিতে রক্ত-পুঁজ হয়ে তা ফেটে গেছে। এখন বিভিন্ন স্থান থেকে মাংস খসে পড়ছে।
তিনি বলেন, আমি রোগাক্রান্ত দুটি গরুকে প্রথম থেকে আলাদা রাখলেও আমার খামারে থাকা আরেকটা গরুর গায়েও দু’দিন আগে গুটি বের হতে শুরু করেছে। তবে কেউ কোনো নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন দিতে পারছে না। মনে হচ্ছে- খামারের ৬টা গরু মরে যাবে বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
আরেক খামারি রইছ উদ্দিন বলেন, অন্যদের খামারে রোগ দেখে আমি প্রথম থেকে পশু চিকিৎসকের কথামতো ঔষধ খাওয়াচ্ছিলাম। নিয়মিত গোসল করানো থেকে শুরু করে গরুর ব্যাপক যত্নও নিয়েছি। তবুও মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) রাত থেকে আমার দু’টি গরুর গায়ে ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ’ বের হতে শুরু করেছে। কেউ ভালো কোনো চিকিৎসা দিতে পারছে না। কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
মহাদেবপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. খুরশিদ আলম বলেন, ‘উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখছি। আমরা এ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ আক্রান্ত গরুর খবর পেয়েছি। উপজেলার এনায়েতপুর, রাইগাঁ, চেরাগপুর ইউনিয়নে এই রোগে বেশি গরু আক্রান্ত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজে এখনও উপজেলায় গরু মারা যাওয়ার খবর পাইনি। তবে অর্ধশতাধিক গরুর অবস্থা খুবই নাজুক। গরুর শরীর থেকে মাংস খসে পড়ছে। কিছু মানুষের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, এই রোগ মানুষেরও হতে পারে। যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে সচেতন করতে লিফলেট বিলি করছি। এই রোগে শুধুমাত্র গবাদিপশু আক্রান্ত হয়। মানুষ আক্রান্ত হয় না।’
রাজশাহী প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী- লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগটি ১৯২৯ সালে প্রথম জাম্বিয়াতে দেখা যায়। পরে তা আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে এবং ২০১৪-২০১৫ সালের দিকে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তানসহ আশেপাশের দেশে দেখা যায়।
২০১৬ সালে লাম্পি ডিজিজ গ্রীস, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়ায়, সার্বিয়া, কসোভোতে ছড়ায়। চলতি বছর এশিয়া মহাদেশের চীন ও ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রথম নওগাঁয় গবাদিপশুর এ রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উচ্চপদস্থ চিকিৎসকরা বলছেন- লাম্পি স্কিন ডিজিজ আক্রান্ত পশুর লালা, নাক-চোখের ডিসচার্জ, ষাড়ের বীর্য, আক্রান্ত গরুর দুধ ও ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনুকূল পরিবেশে এ ভাইরাস ছয়মাস পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে।
জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ডা. মো. রুহুল আমিন আল ফারুক বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘নওগাঁয় বেশ কিছু জায়গায় এমন রোগ ছড়িয়েছে বলে আমরা অবগত হয়েছি। এরমধ্যে মহাদেবপুরে বেশি। রোগটা আমাদের দেশে একেবারে নতুন। প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে আমরা যে ২৭টি ভ্যাকসিন উৎপাদন করি, তা এ রোগের জন্য দেওয়া যাবে না। যেহেতু এ রোগ আগে আমাদের দেশে ছড়ায়নি তাই আমরা ভ্যাকসিনও উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এটা ভাইরাসজনিত রোগ। গরুর গায়ে বসা ‘আটালি বা ডাস’ আক্রান্ত গরুর শরীর থেকে রক্ত খেয়ে যখন আরেক গরুর গায়ে গিয়ে বসে কামড় দেয়, তখন সেই গরুটিও এ রোগে আক্রান্ত হবে। ফলে আক্রান্ত গরুকে মশারির মধ্যে রাখা বা যেখানে আটালি বা ডাস গরুর গায়ে বসবে না এমন স্থানে রাখতে হবে। এটা হলে সঙ্গে সঙ্গে গরু মারা যায় না। মৃত্যুহার কম, কিন্তু আক্রান্ত গরু পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। যেহেতু লাম্পি ডিজিজের কোনো ভ্যাকসিন আমাদের কাছে বা বাজারে নেই, সেজন্য প্রচলিত অন্য কোনো ঔষধ খাইয়ে এবং সেবাযত্নে গরুকে সুস্থ করতে হবে।