একটি জাতি গড়ে ওঠে ধাপে ধাপে। আমাদের জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একক নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি বাঙালি জাতি গঠনের সকল ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদান রেখেছেন। আমরা যদি ইতিহাস দেখি, তাহলে দেখতে পাবো যে স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের পরিচয় কখনই ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের অধীন থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা যখন “পূর্ব পাকিস্তান” হিসাবে পরিচয় পাওয়ার পরেও প্রকৃত অর্থে আমরা স্বাধীনতা পাইনি। যে জাতির উপরে তাদের বহু বছরের মাতৃভাষা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বিদেশি এক ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়, যে জাতিকে তাদের প্রাণের নেতার কাছ থেকে অন্যায়ভাবে বিচ্ছিন্ন রাখা হয় তাদেরকে আর যাই হোক স্বাধীন জাতি বলা যায় না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু কি পরিমাণ আত্মত্যাগ করেছেন তা আসলেই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বাঙালি জাতির অধিকার এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার থাকার ফলে তাঁকে ১৪ বছর জেল খাটতে হয়েছে। দিনের হিসাবে এই সংখ্যা দাড়ায় ৪ হাজার ৬৮২ দিন। এই দীর্ঘ সময় জেলে থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু দেশ ও গোটা বিশ্ব সম্প্রদায়ে যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন তা আজ পর্যন্ত অতুলনীয়।
বঙ্গবন্ধু আক্ষরিক অর্থেই গোটা বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন। উনার ব্যক্তিত্ব এতোটাই বিশাল ছিল যে বিশ্বের সকল প্রান্তের নেতার মাঝেও বঙ্গবন্ধুকে নেতা মনে হতো। উনার উদারতা, উনার নেতৃত্ব গুণাবলী ও জনগণের মনে স্থান তৈরি করে নেওয়ার ক্ষমতা অভিভূত করেছে বিশ্বের সকল দেশের নেতাকে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁর বিশালতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।”
সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন কতটা কঠিন তা আমরা আমাদের ইতিহাস দেখলে অনুধাবন করতে পারবো। ১৮৫৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সিপাহী-জনতার সম্মিলিত সংগ্রাম সফল হয়নি, যার অন্যতম কারণ শুরু থেকে দক্ষ নেতৃত্বের অভাব। ফলে প্রায় দুই শতক ব্রিটিশদের অধীনে থাকতে হয়েছে আমাদেরকে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও একে ঠিক স্বাধীনতা বলা যায় না, কারণ আমাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনেই থাকতে হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতার জন্য এখনো অনেক জাতি সংগ্রাম করে চলেছে, কিন্তু তারা সফলতা পাচ্ছে না। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল দেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণকে স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত করে তোলা। তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙ্গালিদেরকে উজ্জীবিত করেছেন, নিজে আত্মত্যাগ করে সকলকে উজ্জীবিত করেছেন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তিনি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জাতি ধাপে ধাপে গড়ে তোলায় বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতা ছিল বিস্ময়কর। অত্যন্ত স্বল্প সময়ে দেশের কৃষিক্ষেত্র, অর্থনীতি, শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্বনির্ভর একটি জাতি গড়ে তোলার সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা সত্যিই বিস্ময়কর। সেই লক্ষ্যে রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় গড়ে তোলেন দেশের প্রথম আর্থ স্টেশন। সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পেয়েছে ২০১৮ সালে বর্তমান সরকার এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্ব এবং দৃঢ় মনোবলের কারণে। মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট, যা যথার্থভাবেই নামকরণ করা হয়েছে জাতির জনকের নামে।
এ জন্যই বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের জাতির জন্য এক মহামূল্যবান সম্পদ। কোন জাতির ইতিহাসে এমন মহামূল্যবান সম্পদের আবির্ভাব হতেও পারে, না ও হতে পারে।এমন মহামূল্যবান সম্পদ দ্বারা জাতি বিশেষভাবে উপকৃত হয়। আমাদের ক্ষুদ্র আয়তনের এই দেশে খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ খুব সীমিত। বিশাল জনসংখ্যার চাপ সামলানোর জন্য এই দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার কোন বিকল্প নেই। আর জনসম্পদ তৈরি করার জন্য, দেশ ও তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত দক্ষ নেতা।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো যে, বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল এক নেতাকে আমরা পেয়েও রক্ষা করতে পারিনি। যে নেতা আমাদের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত আত্মত্যাগ করলেন; তাঁর আদর্শ, তাঁর ঐতিহ্যকে আমাদেরকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জাতি যে আঁধারে নিমজ্জিত হয়েছিল, সেই অবস্থান থেকে আজ আমরা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের গুণাবলীর কারণে।
জাতি হিসাবে আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর সুযোগ্য কন্যাকে নেতা হিসাবে পেয়েছি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁদের চোখের সামনে উদাহরণ হিসাবে পেয়েছে এক দক্ষ নেতার নেতৃত্ব গুণাবলী। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী চক্ররা দেশকে আবারো পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার হীন চক্রান্তে ব্যস্ত, তাদের প্রধান লক্ষ্য দেশ ও জনগণের নেত্রী শেখ হাসিনা। আমরা বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে যে মারাত্মক ভুল করেছিলাম, সেই ভুল আর করা যাবে না। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সকল ষড়যন্ত্র হতে রক্ষা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের বর্বরোচিত এক জঘন্য হত্যাকাণ্ড। অনেক দেশের অনেক নেতাকেই জঘণ্যভাবে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বর্বরতা সকলকেই ছাড়িয়েছে। তাঁর স্ত্রী, শিশু সন্তানসহ গোটা পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল শুধুমাত্র বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন করার লক্ষ্যে। সেই জঘন্য রাতে রেহাই দেওয়া হয়নি সন্তানসম্ভাবা মহিলাকেও। বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন করার চক্রান্ত আজও চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে স্বয়ংসম্পন্ন এক দেশে পরিণত হয়েছে, দেশের তরুণ প্রজন্ম আজ আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করে বিশ্ব দরবারে দেশের নাম উজ্জ্বল করছে। দেশে এমন উন্নয়ন অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠেছে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা ও দূরদর্শিতার কারণে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য উন্নত এক দেশ গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। এই উন্নয়নের পথ রোধ করার সকল ষড়যন্ত্র যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে।
লেখক: প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ