ঈদ উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন শহরে ঈদবাজারের প্রভাব রীতিমতো নগরজীবনে বড় সংকট তৈরি করেছে। রাজশাহীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ঈদের কেনাকাটার জন্য লাখো মানুষের সমাগম ঘটছে। কেনাকাটার জন্য ভিড় জমছে বড় শপিংমল, বাজার ও বিভিন্ন মার্কেটে। এর সাথে যোগ হয়েছে রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ির চলাচল, গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে গতিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সড়কগুলোতে প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাস্তায় দীর্ঘ লাইন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, ফলে অফিসগামী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ সকলেরই দুর্ভোগ বাড়ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে রাজশাহী শহরে বিপুল পরিমাণ কেনাকাটার ধুম লক্ষ্য করা গেছে। ঈদবাজারের চাপে শহরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা যেমন- সাহেব বাজার, রাণীবাজার, গণকপাড়া ও রেশমপট্টি এলাকায় যানজট চরম আকার ধারণ করেছে। জনসংখ্যা ও গাড়ির চাপের কারণে সড়কগুলো কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। দেখা গেছে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহনের দীর্ঘ সারি, মানুষের প্রচণ্ড ভিড় এবং দোকানিদের ফুটপাতে পসরা সাজানোর কারণে হাঁটাচলাও হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। যানজটের কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী, বৃদ্ধ ও শিশুদের অভিভাবকরা। এমনকি রোগীদের হাসপাতালেও পৌঁছাতে হচ্ছে দীর্ঘসময় ধরে।
বাজারের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ঈদ আসছে, আমাদের বেচাকেনা ভালোই হচ্ছে, কিন্তু যানজটের কারণে ক্রেতারা ঠিকমতো বাজারে ঢুকতে পারছেন না। অনেকেই বিরক্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এটা আমাদের বিক্রিতেও প্রভাব ফেলছে।
আরেক ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, ঈদে সবচেয়ে বড় ব্যবসা হয়। কিন্তু যানজটের কারণে ক্রেতারা আমাদের দোকানে আসতেই পারছেন না। প্রশাসন দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব।
এদিকে ক্রেতা শারমিন আক্তার বলেন, আমি সকাল ১০টায় বের হয়েছি, কিন্তু মাত্র দুই-তিনটা দোকান ঘুরতেই দুপুর হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভিড়, গরম আর যানজটের মধ্যে হাঁটতেই কষ্ট হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার বলেন, আমরা কয়েকজন বান্ধবী মিলে ঈদের শপিং করতে এসেছি। কিন্তু এই যানজট ও ভিড়ের কারণে খুব সমস্যা হচ্ছে। রাস্তার পাশে দাঁড়ালেও ধুলো-বালি আর যানবাহনের শব্দে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছেন মোহাম্মদ আনিস। এরপরেও এসেছেন পরিবারের জন্য বাজার করতে। তিনি বলেন, আমি বয়স্ক মানুষ, হাঁটতে কষ্ট হয়। কিন্তু এখানে তো হাঁটারও জায়গা নেই। সবাই ধাক্কাধাক্কি করছে, গাড়ি-রিকশা যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কীভাবে কেনাকাটা করব?
যানজট শুধু ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্যই নয়; রোগিদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে রোগীরা সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারছেন না বলে অভিযোগ তাদের।
অ্যাম্বুলেন্স চালক মতিউর রহমান বলেন, জরুরি রোগী নিয়ে আসতে গেলে ভয় লাগে, কখন কোথায় আটকে যাব। বিশেষ করে সাহেব বাজারের সামনের অংশটুকু পার করা খুবই কষ্ট সাধ্য।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিছু রুটে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, বিশেষ করে ভিড় বেশি হওয়া এলাকা থেকে বাস চলাচল সীমিত করা হয়েছে। তবে ঈদবাজারের চাপ এবং নগরীর নানা স্থানে যানজটের জন্য ইতিমধ্যে কার্যকর কোন সমাধান মেলেনি। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা চালু না থাকায় যানজট কমানো সম্ভব হয়নি।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্র্যাফিক) মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম জানিয়েছেন, “অতিরিক্ত রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ, ফুটপাত দখল, এবং অবৈধ পার্কিংই যানজটের প্রধান কারণ। ঈদকে কেন্দ্র করে রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা অস্থায়ী দোকানগুলো যান চলাচলে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছি। রাস্তায় যানবাহন চলাচল ঠিক রাখতে চেষ্টা করছি, কিন্তু মানুষজন আইন মানছেন না, ফলে সমস্যাটা আরও বাড়ছে।
সচেতন মহলের নাগরিকরা বলছেন, ঈদবাজারের জন্য নগরের সড়কপথগুলোকে আরও সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ঈদ মৌসুমে ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং রাস্তায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ট্র্যাফিক পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো এবং বিকল্প রুটের সুবিধা তৈরি করা জরুরি, যাতে মানুষের যাতায়াত আরও নির্বিঘ্ন হয়।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) রাজশাহী জেলা শাখার উপদেষ্টা ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, ঈদ আসলেই সড়কে মানুষের চাপ বেড়ে যায়, ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া অবৈধ পার্কিং, ফুটপাত দখল এবং রিকশা-ভ্যানের অসুস্থ অবস্থান সড়ক চলাচলে বিশাল বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের প্রয়োজন সড়ক নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করা এবং যথাযথ ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, সড়কে মানুষ ও যানবাহনের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রশাসন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্মিলিত প্রয়াসে শহরের যানজট কমানো এবং সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।