কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, আমরা বেশ বড় ধরনের একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছি যে আমরা বেশ বড় ধরনের একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমাদের মনে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে।
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) বিকেলে কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়া আখড়াবাড়ীতে লালন একাডেমির মিলনায়তনে স্মরণোৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করেছি যেন ৫ আগস্টের পরে আমরা অনেক কিছু সমাধান করতে পারব সহজেই, আলোচনার মধ্য দিয়ে, কোনো প্রকার সংঘর্ষ ছাড়া এবং কোনো প্রকার বিতণ্ডা ছাড়া।’
ফরহাদ মজহার আরও বলেন, ‘ক্রমশই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে আমাদের সমাজে সেই যে ঐক্য তৈরি করার যে ভাব, যে মানসিকতা, যে সংস্কৃতি, তার যে নীতি–নৈতিকতার ধারা, সেটা থেকে পিছিয়ে পড়েছি। লালনের ধাম ফকিরের কাছে হস্তান্তর করা হোক।’
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ প্রতিপাদ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি মো. তৌফিকুর রহমান।
স্মরণোৎসবে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি আল-মামুন সাগর, জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি তারিকুল হক।
অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রশিদুজ্জামান।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় শুরু হয়েছে অষ্টপ্রহরব্যাপী সাধুসঙ্গ। এবারের সাধুসঙ্গ একেবারেই ভিন্নভাবে হচ্ছে। নেই কোনো ভিড়, ঠেলাঠেলি। নেই কোনো জটলা। শুধু ফকির, সাধু, বাউলদের পদচারণ ছিল সেখানে। বিকেলে লালন একাডেমির আয়োজনে আলোচনার মধ্য দিয়ে স্মরণোৎসব শুরু হয়েছে। শেষ হবে শুক্রবার বিকেলে। মুল অডিটোরিয়ামের নিচে খন্ড খন্ড আকারে গান গাইছেন লালনের ভক্ত ও অনুসারীরা।
এদিকে সাধু-ফকিরেরা জানালেন, এই অষ্টপ্রহরে তাঁরা গুরুকার্য করবেন। রাখালসেবা, অধিবাস বাল্যসেবা এবং শুক্রবার দুপুরে পূর্ণসেবার মধ্যে তাঁদের সাধুসঙ্গ শেষ হবে। এর মধ্যে তাঁরা গানে গানে লালন শাহকে স্মরণ করবেন। রাতে তাঁরা একতারা বাজিয়ে গান করেন।
গবেষকদের মতে, বাউল সাধক ফকির লালন শাহ’র জীবদ্দশায় দোল পুর্ণিমা উপলক্ষে পালন করা হতো দোল উৎসব। আর দোল পুর্ণিমাকে ঘিরেই বসতো সাধু সংঘ। লালনের সেই স্মৃতির ধারাবাহিকতায় লালন একাডেমীও প্রতিবছর এ উৎসবটিকে 'লালন স্মরণোৎসব' হিসাবে পালন করে আসছে। তবে লালন অনুসারীরা দিনটিকে 'দোল পূর্ণিমা' উৎসব হিসাবেই পালন করে থাকেন।
সাধুগুরু খোদা বক্স সাঁই বলেন, সত্যিকার অর্থে আমরা যারা লালন অনুসারীরা রয়েছি। দোল পূর্ণিমার এ রাতটির জন্য সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। সাঁইজির রীতি অনুসারে দোলপুর্ণিমার রাতের বিকেলে অধিবাসের মধ্য দিয়ে ২৪ ঘণ্টার দোলসঙ্গ শুরু হয়। চৈত্রের পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্নার ছটায় আর মাতাল হাওয়ায় গানে গানে বাউল সাধকরা হারিয়ে যায় ভিন্ন কোনো জগতে। পরের দিন দুপুরে ‘পুণ্যসেবা’ দিয়ে সাধুসঙ্গ শেষ করে আখড়াবাড়ি ত্যাগ করেন বেশির সাধুরা। তাঁরা মনে করেন, মানবধর্মই বড় ধর্ম। একসাথে এভাবে সাধুসঙ্গ করলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধু-গুরুর কৃপা ছাড়া মানুষ মুক্তি পেতে পারে না। তার কৃপায় মানুষ সঠিক পথ দেখে।
মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী শাহের তথ্য অনুসারে জানা গেছে, ‘কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের এই আখড়াতেই ছিল ফকির লালন সাঁইজির প্রধান অবস্থান এবং এখানেই তার প্রয়াণ হয়। বর্তমানে এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং গড়ে উঠেছে লালন অ্যাকাডেমি। এখানে ১৯৬২ সালে সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে।’
বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহ তাঁর জীবদ্দশায় ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে প্রতিবছর চৈত্রের দৌলপূর্ণিমা রাতে ফকিরদের নিয়ে সাধুসঙ্গ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরও সেটা চালিয়ে আসছেন তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা। এ জন্য আখড়াবাড়িতে ভিড় করেছেন ফকির–সাধুরা। তবে রমজানের কারণে এবারের সীমিত পরিসরে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে এক দিনেই শেষ করা হচ্ছে স্মরণোৎসব।