পবিত্র উমরা পালনের জন্য টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। তাদের সৌদি আরবে পাঠানোর কথা বলে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন ‘বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উমরা পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বিমানবন্দর এলাকায় বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলায় ধরণা দেন ভুক্তভোগীরা। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে নানা টালবাহানা শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা পালিয়ে যান। এরপর শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে আশরাফুল আলম, কাওসার ওসমান, রিয়াদ হোসেন ও জাকারিয়া কবিরসহ ১৩ জন ভুক্তভোগী বিমানবন্দর থানায় গিয়ে মামলা করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক প্রতিষ্ঠানটির মালিক রাজিব মাহমুদ টাকা আত্মসাৎ করে মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছেন। চক্রটির সঙ্গে উত্তরার বিএনএস সেন্টারের রোমিং ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সিও জড়িত।
মামলার বাদী আশরাফুল আলম জানান, ‘বিমানবন্দরের বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলার মালিক রাজিব মাহমুদের সঙ্গে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি উমরা হজে যাওয়ার জন্য ১ লাখ 80 হাজার টাকা দিয়ে লিখিত চুক্তি করি। কথা ছিল ১৮ মার্চ আমার ফ্লাইট হবে। কিন্তু যথাসময়ে ফ্লাইট না দিয়ে রাজিব ঘোরাতে থাকে। পরে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দরে এসে দেখি বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলার অফিসে তালা ঝোলানো। তারা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পালিয়ে গেছে।’
আশরাফুল আলম বলেন, ‘বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলা এবং বিএনএস সেন্টারের রোমিং ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামের চক্রটি আমাদের প্রায় দুই শতাধিক মানুষকে উমরা হজে সৌদি আরবে পাঠানোর কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করেছে।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দুই শতাধিক মানুষকে উমরা হজে পাঠানোর কথা বলে পাঁচ কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ওই মামলায় আমরা তিনজনকে গ্রেফতার করেছি।’
তিনি বলেন চক্রটির মূলহোতা রাজিব মাহমুদ ও তার স্ত্রী নীলা আক্তার। বাকিরা তাদের সহযোগী। তারা বিমানবন্দর ও গাজীপুরের শিববাড়ীতে একটি শাখা অফিস খুলে উমরা হজে পাঠানোর কথা বলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, চেক ও মানি রিসিটের মাধ্যমে এসব টাকা সংগ্রহ করেছেন। পরে হজে না পাঠিয়ে তারা পালিয়ে গেছেন। এ চক্রের সঙ্গে বিএনএস সেন্টারের রোমিং ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সিও জড়িত।
রাজীবসহ প্রতারণায় জড়িতদের বিচার দাবিতে গত ৪ মার্চ বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলা সার্ভিসেসের অফিসের সামনে ‘অবস্থান ধর্মঘট’ করেন ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ, এই প্রতারণার সঙ্গে বিমানবন্দরের কিছু লোকও জড়িত।
রাজীব মাহমুদের বাড়ি রাজশাহীর রাজপাড়ার হরগ্রামে। তবে বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে গাজীপুরের জয়দেবপুরের চত্বর শিমুলতলী এলাকায়। তিনি এখন কোথায় গেছেন, তা কেউ বলতে পারছেন না।
মঙ্গলবারের ‘অবস্থান ধর্মঘট’ কর্মসূচিতে আসেন ডেমরা এলাকার বোরহান উদ্দিন ও তার স্ত্রী তাহমিনা বেগম। তারাও হজে যাওয়ার জন্য রাজীবকে টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এই দম্পতি বলেন, ‘আমরা দুজন হজে যেতে রাজিবের অফিসে বসে দুই ধাপে মোট ২ লাখ ৯১ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু হজে যেতে পারিনি। বিমানবন্দরের মতো জায়গায় এমন প্রতারক কীভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসে, তা বুঝতে পারছি না। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
হজ ও উমরার টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। কিন্তু কেন বারবার এ ধরনের প্রতারণার শিকার হতে হয় ধর্মপ্রাণ মানুষের, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগিয়ে যারা সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করে, তাদের বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, তা নিশ্চয়ই ধর্ম মন্ত্রণালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা নয়।
প্রশ্ন উঠছে, এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকাই-বা কী? হজ ও উমরা ব্যবস্থাপনায় সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত এজেন্সির তালিকা ও কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি থাকা উচিত। হজ ও উমরা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স যাচাই করা, অর্থ লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং প্রতিটি কোম্পানির কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। তদারকি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাই কিন্তু এ ধরনের প্রতারণার সুযোগ করে দেয়।
এ প্রসঙ্গে ধর্মীয় চিন্তাবিদ মুফতি অহিদুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ধর্মবিশ্বাস মানুষকে সৎ ও মানবিক হতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু প্রতারক চক্র মানুষের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে নির্মমভাবে প্রতারণা করছে। সৎ ও মানবিক হওয়ার পথ দেখিয়ে তারাই করছে অসততা ও অমানবিক কাজ। প্রতারণার এ ঘটনা সমাজে ধর্মভিত্তিক ভ্রমণ ব্যবস্থাপনার অনিয়ম ও দুর্বলতার মুখোশ খুলে দিয়েছে।’
হজ-উমরায় প্রতারণা প্রসঙ্গে হাবের সহ-সভাপতি হাফেজ নুর মোহাম্মদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষকেও আরও সচেতন হতে হবে। উমরা কিংবা হজ পালনের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে টাকা দেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানটির বৈধতা যাচাই করা প্রয়োজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানোও জরুরি, যেন কেউ সহজে প্রতারিত না হয়। ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে যারা প্রতারণা করে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
‘প্রতারক চক্রকে খুঁজে বের করা জরুরি এবং তাদের এমন শাস্তি দেওয়া দরকার, যেন ভবিষ্যতে উমরা বা হজবিষয়ক জালিয়াতি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়’ যোগ করেন এই হাব নেতা।