আওরঙ্গজেব যেভাবে আবার বিতর্কে
-
-
|

‘ছাভা’ সিনেমায় ভিকি কৌশল, রাশমিকা মান্দানা ও অক্ষয় খন্না
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর দীর্ঘ আড়াইশো বছর পর স্বাধীন ভারতের জন্ম, অথচ আজও সে দেশের রাজনীতি ও সমাজজীবনে আওরঙ্গজেবের মতো বিতর্কিত ঐতিহাসিক চরিত্র যে একটিও নেই, তা বলা যায় হলফ করেই।
ভারতে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে আওরঙ্গজেব যেমন আজও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। এই দুটো রাজ্যেই হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের প্রতীক হিসেবেই তাকে তুলে ধরা হয়েছে।
হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর চোখে তিনি শত শত মন্দির ধ্বংসকারী, নিষ্ঠুর নির্যাতনকারী ও হিন্দুবিদ্বেষী একজন শাসক, অন্যদিকে বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণে তার মতো অর্থ আর কেউ দেননি, রক্তের দিক দিয়েও তিনি ছিলেন দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু কারণ তার প্রপিতামহ আকবর বিয়ে করেছিলেন রাজপুত রমণী যোধাবাঈকে, আওরঙ্গজেবের সভায় যত হিন্দু রাজপুত সভাসদ ছিলেন তত আর কোনো মুঘল বাদশাহর আমলে ছিল না- এমন দাবীও করেন অনেক ইতিহাসবিদ।
বাদশাহ আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বিতর্কের এই আগুনে সদ্য ঘি ঢেলেছে বলিউডে সদ্য মুক্তি পাওয়া এক সিনেমা, যার নাম ‘ছাভা’। এটি একটি মারাঠি শব্দ, যার অর্থ হল সিংহ শাবক। মারাঠা জাতীয়তাবাদের নায়ক ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর পুত্র সম্ভাজী মহারাজকে বন্দি করার পর আওরঙ্গজেব কীভাবে অবর্ণনীয় অত্যাচার করে তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন, সিনেমাটির মূল কাহিনি সেটা নিয়েই।
সুপারহিট এই ছবিটি মুক্তির পর মাসখানেকও হয়নি, এর মধ্যেই সেটি প্রায় হাজার কোটি রুপির বাণিজ্য করার পথে এগোচ্ছে- আর সেই সঙ্গেই আরও একবার আওরঙ্গজেবকে নিয়ে এসেছে ভারতের রাজনীতির ফোকাল পয়েন্টে!
‘ছাভা’তে নামভূমিকায়, অর্থাৎ মহারাজা সম্ভাজীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলিউড তারকা ভিকি কৌশল। কিন্তু সম্ভবত তার চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে ছবিতে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করা অক্ষয় খান্নাকে নিয়ে। এই সিনেমাটি রিভিউ করতে গিয়ে অনেক চিত্র সমালোচক লিখেছেন, ছবিতে সম্ভাজীকে নির্যাতনের দৃশ্যগুলো এতটাই ভয়াবহ ও জীবন্ত ছিল যে হলের ভেতরে বহু বাচ্চা ছেলেমেয়ে ভয়ে কেঁদেই ফেলেছে।
সোশ্যাল মিডিয়াতেও বহু দর্শক তাদের একই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। ‘ছাভা’র একটার পর একটা শো-তে দেখা গেছে সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। ‘ইন্ডিয়া টুডে’তে আরুশি জৈন লিখেছেন, ‘একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী ও একই সঙ্গে দক্ষ শাসকের ভূমিকায় আওরঙ্গজেবের এমন শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়া, অথচ সংযত চিত্রায়ন আমরা আগে দেখিনি।’
ইতিহাস বলে, আওরঙ্গজেব না কি বন্দি সম্ভাজীর ওপর মৃত্যুর আগে টানা ৪০ দিন ধরে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিলেন। সিনেমার প্রয়োজনে সেটাকে ছোট করে তিনদিনে নামিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু তাতে পর্দার আওরঙ্গজেবের নৃশংসতা এতটুকু কমেনি।
এর আগেও ১৯৮৮ সালে পরিচালক শ্যাম বেনেগাল যখন জওহরলাল নেহেরুর আত্মজীবনীর ভিত্তিতে দূরদর্শনের জন্য ‘ভারত এক খোঁজ’ নামে টিভি সিরিয়াল বানিয়েছিলেন, সেখানে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় ছিলেন সুপরিচিত অভিনেতা ওম পুরী। ‘ছাভা’ সিনেমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন বলিউড তারকা আশুতোষ রানা, তিনি নিজেও বছর চারেক আগে ‘ছত্রশাল’ নামে একটি জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
তবে ভারতের সিনেমা সমালোচকরা প্রায় একবাক্যে বলছেন, ছাভা-তে অক্ষয় খান্নার আওরঙ্গজেবের সঙ্গে একই চরিত্রে তার পূর্বসূরীদের কাজের কোনো তুলনাই চলতে পারে না। আরুশি জৈনের কথায়, ‘‘আওরঙ্গজেব মানে যে বলিউডের একপেশে ও একমাত্রিক একজন ভিলেন শুধু নন, অক্ষয় খান্না সেটা নিশ্চিত করতে পেরেছেন। মুঘল বাদশাহর সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত নৃশংসতা, তাও সেটা আবার খুব পরিমিত তীব্রতার সঙ্গে, তার অভিনয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আমি তো বলব সিনেমায় তার স্তব্ধতাই ছিল বিস্ফোরক! কোনো সংলাপ ছাড়া, শুধু নীরব অভিনয় আর চোখের চাহনিতে যেভাবে ‘ছাভা’র আওরঙ্গজেব দর্শকের মনে ভয় আর ঘৃণার উদ্রেক করতে পেরেছেন, সেটা নিয়ে লেখালেখিও হচ্ছে বিস্তর।’’
ফলে ‘ছাভা’ কেন আর কীভাবে আবার আওরঙ্গজেবকে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, তা অনুমান করা শক্ত নয় মোটেই।