ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে একদিনের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় গত মার্চে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি ডলার।
গত বৃহস্পতিবার টাকার অবমূল্যায়নের আগে ডলারের দাম ১১০ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার থেকে ১১৮ টাকা হিসাবে ঋণ বেড়েছে ৪৯ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।
এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বাড়ায় বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সুদের টাকা যোগ করলে মোট অঙ্ক দাঁড়ায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সূত্র জানায়, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে তা দেশীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে উদ্যোক্তা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় স্থানীয় মুদ্রাকে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর করতে হয়। ওই সময়ে বাজারে প্রচলিত ডলারের দামে বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে হয়। এ কারণে ডলারের দাম বাড়লে বৈদেশিক ঋণ টাকার হিসাবে বেড়ে যায়।
এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বাড়লে ঋণের অঙ্কও বাড়ে। কারণ, ঋণ পরিশোধের সময় প্রচলিত বিনিময় হার ও সুদহারে ঋণ পরিশোধের শর্ত থাকে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি থাকলে ঋণের ঝুঁকি আরও বেশি বাড়ে। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি। এ কারণে ঋণ পরিশোধের চাপও বেশি। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নমুখী রয়েছে।
একই সঙ্গে ডলারের দামও বাড়ছে। বর্তমানে নিট রিজার্ভ ১৮৪৮ কোটি ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে তা বেড়ে সর্বোচ্চ গ্রস রিজার্ভ ৪৬০৮ কোটি ডলারে উঠেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকর প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ৯ হাজার ৬৫২ কোটি ডলার। ওই সময়ে ডলারের দাম ছিল ১০৩ টাকা। ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার। ওই সময়ে ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা। এতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা।
আলোচ্য সময়ে ঋণ বেড়েছে ৪১২ কোটি ডলার। গত মার্চে তা আরও বেড়ে ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ১০ হাজার ৭২ কোটি ডলারে। ফলে গত ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি ডলার। গত ডিসেম্বর থেকে বুধবার পর্যন্ত ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১১০ টাকা। এ হিসাবে ঋণ বেড়েছে ৪৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
গত বৃহস্পতিবার থেকে ডলারের দাম বেড়ে ১১৮ টাকা হয়। এতে একদিনের ব্যবধানে ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।
এদিকে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। করোনার আগে লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটে (লাইবর) ডলারে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হার ছিল দেড় থেকে ২ শতাংশ। এর সঙ্গে আড়াই থেকে ৩ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদ নির্ধারিত হতো। এ হিসাবে সুদের হার পড়ত ৪ থেকে ৫ শতাংশ।
বর্তমানে লাইবর রেট বেড়ে ডলারে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সি রেট (সোফর) ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। এর সঙ্গে আড়াই শতাংশ যোগ করলে সুদের হার দাঁড়ায় ডলারে ৮ দশমিক ২১ শতাংশ । তিন শতাংশ যোগ করলে সুদের হার আরও বেশি পড়ে। ফলে ঋণের সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে ঋণের স্তিতি বাড়ছে।
এছাড়া ঋণ পরিশোধ মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানোর ফলে বাড়তি সুদের পাশাপাশি দণ্ড সুদও দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে এর বিপরীতে দণ্ড সুদসহ চড়া সুদ দিতে হয়।
গত বছর স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৯৩ কোটি ডলার। ডলারের দাম ১১০ টাকা হিসাবে ১০ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। চলতি বছরে পরিশোধ করতে হবে ১১৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৫০ কোটি ডলার ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। আরও ৬৩ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। সাময়িক হিসাবে ডলারের দাম ১১০ টাকা হিসাবে ৬৯৩০ কোটি টাকা। ১১৮ টাকা হিসাবে ৭৪৩৪ কোটি টাকা। বেশি পরিশোধ করতে হবে ৫০৪ কোটি টাকা।
করোনার সময় থেকে ব্যবসায়িক মন্দার কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। ফলে ঋণের অঙ্কও বেড়েছে। এর মধ্যে ঋণ পরিশোধ বাড়লেও ঋণের স্থিতি গত বছরের মার্চে কিছুটা কমলেও এখন আবার বেড়ে গেছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ ছিল ৭ হাজার ২২১ কোটি ডলার। গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৯৮১ কোটি ডলার। বেড়েছে ৭৬০ কোটি ডলার। ডলারের দাম ১১০ টাকা হিসাবে ঋণের পরিমাণ ৮৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ১১৮ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এ খাতে ঋণ বাড়ছে ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা।
সরকারি খাতের বেশির ভাগ ঋণই দীর্ঘমেয়াদি। যে কারণে এগুলো দীর্ঘ সময় নিয়ে পরিশোধের সুযোগ রয়েছে। এতে ঝুঁকির মাত্রা কম। কিন্তু বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি। এগুলো ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। সুদহারও বেশি। যে কারণে এগুলোতে ঝুঁকি বেশি। এসব ঋণই বেশি স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বেশি মাত্রায় পরিশোধও হচ্ছে।
বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২৪৩১ কোটি ডলার। গত মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ২০৯৫ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ঋণ কমেছে ৩৩৬ কোটি ডলার। ডলারের দাম ১১০ টাকা হিসাবে ঋণ কমেছে ৩৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। ১১৮ টাকা হিসাবে কমেছে ৩৯ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ঋণ কমার মাত্রা বেড়েছে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের ঋণের মধ্যে আমদানি খাতের ঋণই বেশি। এর মধ্যে ট্রেড ক্রেডিট ও বৈদেশিক এলসির দায় বাড়ছে। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
অন্যান্য খাতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঋণ ছিল ১১৪২ কোটি ডলার। গত মার্চে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১৭৮ কোটি ডলার। ঋণ বেড়েছে ৩৬ কোটি ডলার। ডলারের দাম ১১০ টাকা হিসাবে ঋণ বেড়েছে ৩৯৬০ কোটি টাকা। ১১৮ টাকা হিসাবে বেড়েছে ৪২৪৯ কোটি টাকা। টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে ঋণ বেড়েছে ২৮৮ কোটি টাকা।