• ধনী ও দরিদ্রের সম্পদের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে
• মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনধারণ করতে হিমশিম খাচ্ছে দরিদ্ররা
• বৈষম্য ছড়িয়ে পড়েছে সুযোগ ও অধিকারের ক্ষেত্রেও
• বৈষম্য দূরীকরণে দৃশ্যমান প্রতিশ্রুতির ঘাটতি
• বৈষম্যের ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি
• বিশ্বে অতি ধনীর উত্থানে বাংলাদেশ শীর্ষে
সারাবিশ্বে সব গরীব লোকের অর্ধেকের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে মাত্র ২৬ জন ধনীর হাতে রয়েছে সে পরিমাণ সম্পদ। এমন খবর জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফাম। সম্প্রতি ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ এর বৈঠকের প্রাক্কালে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
বিশ্বের ২৬ জন ধনী ব্যক্তির যে সম্পদ আছে তা ৩৮০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের সমান। ওই ২৬ জন ধনীর সম্পদের পরিমাণ ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার। তাদের সম্পদ গত বছর প্রতিদিন ২৫০ কোটি ডলার করে বেড়েছে। ধনীর ধন বাড়লেও দরিদ্রের সম্পদ কমেছে। ৩৮০ কোটি মানুষের সম্পদ গত বছর ১১ শতাংশ কমেছে। ধনী ও দরিদ্রের সম্পদের এই বৈষম্য অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি জন-অসন্তোষকেও উসকে দিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্সের চলমান ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এই আন্দোলনের শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা সামাজিক জীবনের নানা অসংগতির প্রতিবাদ হয়ে ওঠেছে। এই ক্ষোভের বড় একটি কারণ, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ধনীদের কর রেয়াদের একটি সুযোগ দিয়েছেন। মূল্যস্ফীতির কারণে গরীবেরা জীবনধারণ করতে হিমশিম খাচ্ছে আর ধনীদের আরও ধন বাড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার-এটা মেনে না নিয়ে রাস্তায় এসে বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন হাজারো বিক্ষোভকারী।
গত বছর ৩৮০ কোটি মানুষের মোট সম্পদ ১১ শতাংশ কমেছে। ধনী ও গরিবের মধ্যে সম্পদের এই বিশাল ব্যবধানের কারণে দারিদ্র্যের মোকাবিলা করা অসাধ্য হয়ে পড়েছে। আর যা অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। গবেষণা প্রতিবেদনে অক্সফাম আরও বলছে, অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যতা রক্ষা করতে হলে এসব ধনী ব্যক্তিদের ওপর বেশি করে করারোপ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী ধনী ও দরিদ্রের এই বৈষম্য দূর করতে সরকারের পাশাপাশি ধনকুবেরদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে অক্সফাম।
কালের নিয়মে পুরনো বছর বিদায় নেয়, নতুন বছর আসে। অর্থনীতির উন্নতি হয়৷ কিন্তু লাভ হয় কেবল বড়লোকদেরই৷ গরিব মানুষের জীবনে কোনো উন্নতি নেই৷ অক্সফামের প্রতিবেদন সেই সত্যটাই নতুন করে তুলে ধরেছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় সাড়ে চারশ' বছর আগে এথেন্সে বসে দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, ‘‘শহরের আকার যত ছোটই হোক না কেন, তা মূলত দু'ভাগে বিভক্ত৷ অতি ধনী আর অতি গরিব৷ এই দু'পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলবেই৷’’ প্লেটোর মৃত্যুর এত বছর পরেও মূলগত সেই যুদ্ধের অবসান ঘটেনি৷ ‘যুদ্ধ’ চলছেই৷
শুধু আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেই নয়, বাংলাদেশেও উদ্বেগজনক হারে বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্য বলতে আমরা সাধারণত সম্পদের বৈষম্য তথা অর্থনৈতিক বৈষম্যকেই বুঝি। ইংরেজি ভাষায় এই পদবাচ্যটি পরিচিত ইনইকুয়ালিটি বা ইকোনমিক ইনইকুয়ালিটি নামে। অতএব, এই বৈষম্য বা ইনইকুয়ালিটি হচ্ছে একটি ইকোনমিক ফেনোমেনন তথা অর্থনীতিসংক্রান্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়। সম্পদের সমবণ্টন হচ্ছে এর সমাধান। আমরা বরাবর এই বৈষম্য অবসানের কথা বলে আসছি। শুধু বলে আসছি না, তা অবসানে সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতিও ঘোষণা করে আসছি। কিন্তু এর পরও অর্থনীতিতে এই বৈষম্যের অস্তিত্ব গোটা মানবজাতির ইতিহাসজুড়ে অবিচ্ছেদ্য বিষয় হয়েই রয়েছে। তবে এই বৈষম্য শুধু সম্পদের মধ্যেই সীমিত নয়, এটি ছড়িয়ে পড়েছে সুযোগ ও অধিকারের ক্ষেত্রেও। এই বৈষম্যবিরোধী যুক্তির পাশাপাশি আছে বৈষম্যকে যৌক্তিক করে তোলার নানা ধরনের যুক্তির অস্তিত্বও, যা আমরা লক্ষ করেছি নানা সময়ে নানাভাবে।
আমাদের দেশে বৈষম্য কমানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতির ঘাটতি রয়েছে। ক্রমবর্ধমান এই সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থতার কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এ বৈষম্য-সঙ্কট অপরিহার্য নয়, সরকারগুলো এর বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীন নয়। বৈষম্য হচ্ছে নীতিনির্ধারণের বিষয়। করের সামঞ্জস্য বিধান এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আরো কিছু দেশে দেখা গেছে করদাতার সংখ্যা খুবই কম। করের ভিত্তি সম্প্রসারণের পরিবর্তে কোম্পানি ও ব্যক্তির ওপর করের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। দেশগুলোর প্রবণতা হচ্ছে, ভ্যাটে ও অন্যান্য অপ্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল হওয়া। অনেক দেশ জেন্ডার-সেন্সেটিভ ট্যাক্সেশনের সমস্যাটি দূর করা হয়নি। ফলে অনেক নারীর ওপর অন্যায্যভাবে কর আরোপ করা হয়। তাদের জন্য শুধু ন্যায্যতাভিত্তিক করারোপ নয়, পাশাপাশি এদের জন্য প্রয়োজন আরো সরকারি তহবিল সেবার।
অক্সফামের প্রতিবেদনে সুপারিশ রাখা হয়েছে- সব দেশকে তাদের বৈষম্য অবসানে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে প্রতিটি দেশ বৈষম্য অবসানে ১০টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে। এই পরিকল্পনায় থাকতে হবে, সরকারি খরচে বিনামূল্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এবং সার্বজনীন সুরক্ষা ফ্লোর।
বাংলাদেশে যে সম্পদের বৈষম্য উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, তা আঁচ করা যায় সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে। রিপোর্ট মতে, একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর ফলে এই বৈষম্য আরো বাড়ছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বে অতি ধনীর উত্থানে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। অর্থাৎ, অতি ধনী বা ধনকুবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে দেশে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ১৭ শতাংশ হারে। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭০টি বড় অর্থনীতির দেশের হারের চেয়ে বেশি। ‘ওয়েলথ-এক্স’ নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, এটি অবাক করা বিষয় যে- ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে চীন বিশ্বের ১ নম্বর নয়। ১ নম্বর অবস্থান বাংলাদেশের।
বাংলাদেশে বৈষম্য বেড়ে চলেছে এবং তা বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে- উল্লিখিত রিপোর্ট দু’টি এ বিষয়টি নিশ্চিত করে। সমাজবাদীদের অভিযোগ, এই বৈষম্যের পেছনে রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। অনেকেই বাংলাদেশের এই বৈষম্যের জন্য দায়ী করেন বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে। তারা হয়তো সমাজবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমর্থনে এ ধরনের অভিযোগ করে থাকেন। তাদের এই দাবি নিয়ে বিতর্ক থাকার অবকাশ থাকতে পারে। তবে এ কথা সত্য, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বৈষম্য অবসানের সহায়ক নয়। কারণ, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাব রয়েছে। যার ফলে এই ব্যবস্থায় দেশে একটি লুটেরাগোষ্ঠী সৃষ্টি হয় সহজে।
বাংলাদেশে শুধু আয় বৈষম্যই নয়, সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) দেয়া তথ্য মতে, গিনি কোএফিশিয়েন্ট বিবেচনায় সম্পদ-বৈষম্যের উদ্বেগজনক পরিমাণ ০.৭৪, যেখানে আয়ের বৈষম্যের বেলায় এই গিনি কোএফিশিয়েন্ট হচ্ছে ০.৪৮। উল্লেখ্য, গিনি কোএফিশিয়েন্ট হচ্ছে ০ থেকে ১ পর্যন্ত আয়বৈষম্য ও সম্পদ-বৈষম্য পরিমাপের একটি অর্থনৈতিক পদবাচ্য, যেখানে ১ নির্দেশ করে পরিপূর্ণ বৈষম্য এবং ০ নির্দেশ করে পরিপূর্ণ সমতা।
আমাদের সমাজের সবচেয়ে বেশি ধনীরা তাদের প্রকৃত আয় ও সম্পদের পরিমাণ প্রকাশ করতে রাজি হন না। অনেক সম্পদশালী ব্যবসায়ীকেও সেরা করদাতাদের তালিকায় পাওয়া যায় না। গত বছর যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি কর দিয়েছেন, তিনি একটি তামাক কোম্পানির মালিক। এখানে কৌশলী বিষয়টি হচ্ছে, অনেক অতি ধনী তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির জন্য ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেন। যখন আপনি দেখাবেন, আপনার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল এসেছে ঋণের টাকা থেকে, তখন আপনি করদাতাদের তালিকায় না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া, ধনীদের ওপর কর আরোপ না করার একটি প্রবণতা কাজ করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে। সময়ের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব ক্রমবর্ধমান হারে চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে; তখন এই প্রবণতা আরো বাড়বে বলেই ধরে নেয়া যায়।
পাশ্চাত্যে দেখা যায়, নিম্নতম মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি একটি জনপ্রিয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি বা বিরোধী কোনো বড় রাজনৈতিক দলকেই তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের নিম্নতম বেতন বাড়ানোর পক্ষে পাওয়া যায় না। আসলে কোনো দলই চায় না তাদের অর্থনৈতিক পার্টনার ও চাঁদা প্রদানকারীদের বিরক্ত করতে। অপর দিকে অতি ধনীদের ওপর করারোপ করার পরিবর্তে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার প্রণোদনা দেয়ার নামে কার্যত ধনীদের করের পরিমাণ কমানোর অপ্রত্যক্ষ দাবি পূরণেই আগ্রহী। যখন শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নামেন তখন সরকার শিল্পমালিকদের সমর্থনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নামিয়ে শ্রমিকদের কণ্ঠ রোধ করে।
অতএব আমরা বলতে পারি, আমাদের যে করনীতি তা আসলে কাজ করছে দেশে বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তোলার পেছনে। অথচ অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, করনীতির মুখ্য দর্শন হচ্ছে সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনা। আমাদের ভুল করনীতির কারণে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি ধনীদের করের আওতায় আনতে। আর এই নেতিবাচক প্রভাবে সমাজে বাড়ছে বৈষম্য। দুর্নীতি বৈষম্য বাড়ানোর অন্যতম উপসর্গ হলেও ক্ষমতাসীনরা এখনও পর্যন্ত বড় দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করতে কোনো কঠোর ভূমিকা নেয়নি। একে একে লুট হচ্ছে আমাদের ব্যাংকগুলো। এগুলো সবই দেশ ও সমাজে বৈষম্য বাড়ানোর সহায়ক উপাদান। অতএব, দেশের বৈষম্য-পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না!
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট