শাদা ঘোড়ার দৌড়
রাত্রির শিকড়ে আমার ঢুলুঢুলু ঘোর। ঘোর একটা আকর গ্রন্থ।
তার চিরল পাতা পৃষ্ঠায় ছাই।
জীবনের কয়লাখনিতে জমা হয় ছাইয়ের স্তূপ। স্তূপে শুয়ে থাকে
চকচকে নক্ষত্র। আমার নক্ষত্র ধোয়া রাত একনিষ্ঠ হয় আকর গ্রন্থে।
প্রতিটি আকরিক নক্ষত্র আমার ছেলেবেলার কুড়ানো পাথর।
পাথর দিয়ে আমি আকাশ
ছোঁয়া ইমারত বানাই। আকাশচুম্বী ইমারতটা নৈশ আলোক।
আমি আলোর চাতালে এসে দাঁড়াই। পান করি আলো।
পাঠ করি জীবন। এই পানশালায় পানরত সবাই প্রতি মুহূর্তে হয়ে ওঠে
এক একটি তেজী ঘোড়া। চারদিকে দৃপ্ত দাপট।
ছড়িয়ে পড়ে আলোক হ্রেষা, খুর। জন্ম নেয় অখণ্ড হীরক।
কুণ্ডলী পাকায় হীরক জোছনা।
আমার ঢুলুঢুলু ঘোর। ঘোর একটা শাদা ঘোড়ার দৌড়।
দ্যুতিমান ঘোড়ার লেজে ঝুলে যায় আমার চোখ।
ওর রেশমি লেজ ছড়িয়ে দেয় সবুজ শস্য ভরা ধান নদী দারুচিনি গ্রাম।
মসলা ঘ্রাণ সচিত্র পাতা বৃক্ষ সবুজ ডাল। ডালের দিকে উড়ে যায় পাখি বনঘুঘু।
গ্রাম বালিকা হাসে। আলোর উৎস মুখে লাল শাড়ি বউ কলসী ডুবায়।
আমরা পান করি আলোর মধু।
স্বপ্নফল
যেদিন জেনে গেছি, একটা স্বপ্নেরই পিণ্ডিফল এই আমি
সবুজ পাতায় মোড়া ঝুলে রয়েছি গাছের শাখায়
বাতাসে দুলছি গাঢ় লাল।
পাখিরা পাকা ফলে ঠোঁট গলাচ্ছে। ঠোকরে ঠোকরে খাচ্ছে
আমারই হৃৎপিণ্ড ফল।
আমি সেদিনই জেনেছি, পাখিজন্মে যারা নেচে উঠেছিল
আমারই মাতৃজঠরে
আমি তাদেরই ঠোঁটে জীবনরস চুইয়ে পড়েছি অনন্তের ফোঁটা।
জীবন-বৃক্ষ থেকে কারো স্বপ্নফল গলে গলে এই আমি
আমারই জন্ম করেছি সার্থক।
তাঁর চাওয়া, তাঁর তৃপ্ত অহং গলে গলে পাখিদের ঠোঁটে।
সাকার
জন্মসূত্রে এই দেহঘরে আমি আমার সাকার পেয়েছিলাম।
এই ঘরে ঠাঁই-ঠিকানা হয়েছিল আমার।
যখন সেই পরম সত্তার প্রদীপ্ত আলো থেকে সহসা ভ্রমণে
বেরিয়ে এসেছিলাম আমি।
ইতোমধ্যেই আমি জেনে গেছি
পৃথিবীর ছায়া-সবুজ আলো-ঝলমল এই মনোমুগ্ধকর বাড়িতে
আমার আর বেশিদিন থাকা চলবে না।
রহস্যঘেরা এই গ্রহের বাসিন্দাদের প্রতিটি মুখে
আমি তাকিয়ে দেখেছি
কারো দেহকোঠাতেই আমার দ্বিতীয় ঠিকানা নেই।
বাঘিনীর দুধ
দৌড়াতে দৌড়াতে কিছু হিংস্র মানুষের ঘা খেতে খেতে
ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আমি যখন জঙ্গলে গিয়ে একটা বাঘিনীর গুহায়
আশ্রয় নিয়েছিলাম
আমাকে হত্যার জন্যে লোকগুলো জঙ্গলে হানা দিয়েছিল
তছনছ করে যাচ্ছিল জঙ্গলের নিঝুম প্রহর
আমার দুঃখে বনের পাখিরাও যখন সমব্যথী হয়ে চিৎকার শুরু করেছিল
আমি তখন একটা মা বাঘিনীর দুধেই প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম।
আর বাঘিনীর দুধের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম কোনো কবিতা আমি পান করিনি
জীবনের এই ঘোর জঙ্গলে কবিতা ছাড়া আমি আর অন্য কিছু ভাবি না।
কাঠঠোকরা
বাবা আমাকে আলপথ ঘুরিয়ে এনে অদৃশ্য হন।
বাংলাদেশের চৌহদ্দি ঘুরে, আমি যেন কাঠঠোকরাদের
জঙ্গলে ঢুকে পড়ি।
কাঠঠোকরারা ছিদ্র করে চলে গাছের শহর।
আমি জীবনের সীমানা পেরিয়ে যাব না। আমার পিঠ
এলিয়ে দিই কাঠঠোকরাদের ঠোটে। সে আমার বুকে
পা তুলে বসে যায়
কণ্ঠায় ছিদ্র করে চলে অবিরাম ধারালো বাটাল।