বরিশালে সয়াবিন চাষ বাড়লেও তেল উৎপাদন কম
-
-
|

ছবি: বার্তা২৪.কম
বাংলাদেশে উৎপাদিত সয়াবিনের প্রায় ৪০ শতাংশ বরিশালে আবাদ হয়। তবে উন্নত বিপণন ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তি ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে সয়াবিনের উৎপাদন ও ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না।
দেশের বিপুল পরিমাণ সয়াবিন উৎপাদিত হলেও তা মূলত হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার তৈরির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বরিশালসহ সারাদেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে এটি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য অনুসারে, চলতি রবি মৌসুমে দেশে প্রায় ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ হয়েছে, যার মধ্যে বরিশাল কৃষি অঞ্চলেই ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিনের চাষ করা হয়েছে। ফলে দেশে মোট উৎপাদিত সয়াবিনের প্রায় ৪০ ভাগই বরিশাল অঞ্চল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে।
চলতি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে সয়াবিনের উৎপাদন প্রায় ১ লাখ টন ছুঁতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সমগ্র দেশজুড়ে এ মৌসুমে সয়াবিনের উৎপাদন ২ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন। বরিশালের হিজলা, মুলাদী, মেহেন্দিগঞ্জ অঞ্চলে আগামী মাসের মধ্যভাগ থেকেই সয়াবিন সংগ্রহ শুরু হবে।
সয়াবিন তেল জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি ৪০-৪৫% আমিষ এবং ১৯-২২% পর্যন্ত তেল ধারণ করে। অন্যান্য ডাল বা শস্যের তুলনায় সয়াবিনে আমিষের পরিমাণ বেশি। অল্প খরচে উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার হিসেবে সয়াবিনের গুরুত্ব অপরিসীম।
গত বছর দেশে ১৪ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ২২ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের তেলবীজ উৎপাদিত হয়েছিল, যা দেশের মোট ভোজ্যতেলের চাহিদার অর্ধেকেরও কম। ফলে বাংলাদেশকে এখনও বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল এবং তেলবীজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, যা দেশের জন্য বিরাট বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের কারণ।
যদিও বরিশালে সয়াবিন উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়ছে, কিন্তু তা ভোজ্যতেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ, কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সয়াবিন ভোজ্যতেল উৎপাদনকারীদের কাছে বিক্রি করতে পারছেন না। বরং বিভিন্ন ফিসফিড ও পোল্ট্রি ফিড কারখানার ফড়িয়ারা মাঠ থেকেই নির্ধারিত দামে সয়াবিন কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রায় ২ লাখ টন সয়াবিন তেলবীজ সম্পূর্ণরূপে পোল্ট্রি ফিডের কারখানায় চলে যাচ্ছে।
কোনো ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সয়াবিন ক্রয় না করায় এটি খাদ্যতেল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে দেশীয় ভোজ্যতেলের উৎপাদনও বাড়ছে না।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ৪০টিরও বেশি উন্নতমানের তেলবীজ জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে সয়াবিনের ৬টি উচ্চফলনশীল জাত রয়েছে। এসব উন্নত জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,সোহাগ-পিবি-১,বাংলাদেশ সয়াবিন-৪ (জি-২),বারি সয়াবিন-৫,বারি সয়াবিন-৬।
এসব জাতের সয়াবিনের ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৮০ থেকে ২.২৫ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। বরিশালের নদী বিধৌত দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ এবং এঁটেল দো-আঁশ মাটি সয়াবিন চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। কিন্তু উন্নত জাতের সয়াবিন বীজ ও আবাদ প্রযুক্তি এখনও কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছেনি। যদি এসব প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বরিশাল অঞ্চলে অন্তত ২ লাখ টন সয়াবিন তেলবীজ উৎপাদন সম্ভব।
বরিশালের মুলাদী উপজেলার কৃষক আবদুল হাকিম বলেন, প্রতি বছরই আমি কয়েক বিঘা জমিতে সয়াবিন চাষ করি। ফলনও ভালো হয়, কিন্তু লাভ ঠিকমতো হয় না। কারণ আমাদের উৎপাদিত সয়াবিন আমরা সরাসরি ভোজ্যতেল কারখানায় বিক্রি করতে পারি না। মাঠে আসা ফড়িয়ারা কম দামে আমাদের কাছ থেকে সয়াবিন কিনে নেয় এবং পরে তা পোল্ট্রি ও ফিস ফিড কারখানায় চলে যায়। ফলে আমাদের ন্যায্যমূল্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
বরিশালের হিজলা উপজেলার কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সয়াবিন চাষে খরচ বাড়ছে, কিন্তু দাম আগের মতোই রয়ে গেছে। যদি সরকার স্থানীয় পর্যায়ে তেল উৎপাদনের ব্যবস্থা করত, তাহলে আমরা ভালো দাম পেতাম। এখন যে দামে সয়াবিন বিক্রি করি, তাতে খুব বেশি লাভ হয় না। বরং ধান চাষ করলে লাভ বেশি হয়।
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার তরুণ কৃষক রাশেদ মিয়া বলেন, আমরা শুনেছি যে উন্নত জাতের সয়াবিন আছে, যার ফলন বেশি হয়। কিন্তু আমরা সেগুলোর বীজ সহজে পাই না। যদি সরকার আমাদের উন্নত জাতের বীজ ও সঠিক প্রশিক্ষণ দিত, তাহলে আমরা আরও বেশি সয়াবিন চাষ করতে পারতাম এবং লাভবান হতাম।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মরিয়ম বলেন,সয়াবিন তেলবীজের যথাযথ বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং দেশীয় ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়বে। আমরা উন্নত জাতের সয়াবিন আবাদ ও তেল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছি।