ফেনীর ভয়াবহ বন্যার ছয় মাস পার হলেও বন্যার ধকল এখনও কাটেনি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসনে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
জেলা প্রশাসন হতে প্রাপ্ত তথ্য দেখা গেছে, বন্যায় জেলায় সর্বমোট ৮ হাজার ৬৫৯ টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৭১৮ টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার ৯৪১ টি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি বেসরকারিভাবে ঘর মেরামতে সহযোগিতা করা সম্ভব হলেও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। সরকারিভাবে প্রথম পর্যায়ে ১১০ টি ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ের ত্রাণ ও পুর্নবাসন শাখার দেয়া তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারিভাবে ৪০০ বান্ডিল ঢেউটিন ও গৃহ মঞ্জুরি ব্যয় বাবদ ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। যা ২০০ টি পরিবারের মাঝে বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে।
অন্যদিকে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসনে নিজ বসতভিটায় বিশেষ আবাসন নির্মাণ শীর্ষক পাইলট প্রকল্পের আওতায় সেনাবাহিনী কর্তৃক ১১০ টি ঘর নির্মাণের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৫ টি, ফুলগাজী ২০ টি, ছাগলনাইয়া ২০ টি, পরশুরাম ২০ টি, সোনাগাজী ৫ টি ও দাগনভূঞাতে ১০ টি ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। যার মধ্যে দুটি ডিজাইন নির্ধারণ হয়েছে যাতে ঘরপ্রতি ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে ব্যয় হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য দেখা যায়, সরকারি উদ্যোগের বাইরে বেসরকারি ভাবে আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে প্রতি পরিবারে ৪ বান্ডিল করে ১৫৭ পরিবারকে ঢেউটিন এবং নগদ সাড়ে ৬ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। নৌবাহিনী কর্তৃক ৮৫ টি নতুন ঘর নির্মাণের এবং ফুলগাজীতে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১৫ টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ফুলগাজীতে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর উদ্যোগে ১০০ টি ঘর মেরামত করা হয়েছে।
এছাড়াও ইউএনডিপি কর্তৃক প্রথম পর্যায়ে ৩ হাজার পরিবারকে ঘর মেরামত বাবদ ৩০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এবং ২য় পর্যায়ে ২ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও নারী প্রধান ১১শ টি পরিবারকে ১১ হাজার টাকা করে দিবে ইউএনডিপি।
ডব্লিউএফফি কর্তৃক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬ উপজেলার ১৭ হাজার ৯৯৪ টি পরিবারকে ৬ হাজার টাকা করে ১০ কোটি ৭৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও মানুষের আয়বৃদ্ধি কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবিকা সহায়তা বাবদ ১ হাজার ৩২১টি পরিবারের প্রত্যককে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।
আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন কর্তৃক সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ২৮৭টি পরিবারকে সম্পূর্ণ আধাপাকা ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ৮ হাজার ৯৭০ পরিবারকে নগদ ৩০ কোটি ১৯ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে এবং ৬০ জন রিকশাচালককে ৬০টি অটোরিকশা প্রদান করা হয়েছে।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কর্তৃক ৫ হাজার ৫০০ পরিবারকে ৬ হাজার টাকা করা হয়েছে। এছাড়াও ফুলগাজীতে লেট্রিন নির্মাণ ও টিউবওয়েল বিশুদ্ধকরণের কাজ করা রয়েছে। মাস্তুল ফাউন্ডেশন কর্তৃক ৯৯২ পরিবারকে হাউজহোল্ড বিল্ডিং মেটেরিয়্যালস বাবদ ১১ লাখ ৫০০ টাকা, রিক কর্তৃক পরশুরাম উপজেলায় ৮৭০ পরিবারকে বিভিন্ন অনুপাতে নগদ টাকা প্রদান, সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ পরিবারের প্রত্যেককে নগদ ৩০ হাজার টাকা এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ পরিবারের প্রত্যেককে ১৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও ১৯০ পরিবারের মাঝে বিতরণ চলমান এবং বিদ্যালয় ও টিউবওয়েল সংস্কার করা হয়েছে।
ইপসা কর্তৃক ছাগলনাইয়া উপজেলায় সসম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ১৪১ টি পরিবারের প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৪৯৮ পরিবারকে ১৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। নিয়ার কর্তৃক সদর উপজেলার ২৫ পরিবারকে নগদ ২৪ হাজার টাকা করে প্রদান এবং এসসিআই কর্তৃক সদর উপজেলার ১০ পরিবারকে নগদ ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে।
ব্র্যাক কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত ২১৪টি পরিবারকে ঘর মেরামতের জন্য ৩০ হাজার টাকা এবং ১৬২ পরিবারকে জীবিকা পুনরুদ্ধারের জন্য ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করে। এছাড়াও ১ হাজার ৪৭৬ পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। ৫০ টি ইনস্টিটিউশন মেরামতের জন্য ৩০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও গাল্ফ কো অপারেটিভ সোসাইটি, এডজওয়ার সেন্ট্রাল মস্ক লন্ডন, লাইফএইড, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, কেয়ার বাংলাদেশ, অষ্ট্রেলিয়ান হিউমিনিটেরিয়ান পার্টনারশিপ ও বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিগণের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজেলায় ঘর মেরামত, নলকূপ স্থাপনসহ বিভিন্ন সহযোগিতা দেয়া হয়েছে।
সড়কের ক্ষেত্রে এলজিইডির ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ১২০ কি.মি রাস্তা মেরামত করা হয়েছে। ৬৯ টি সড়কে ব্রিজ কালভার্ট সংস্কারের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগে ১৪০০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার কাজ চলমান রয়েছে। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পরশুরামে ৪৭টি, ফুলগাজীতে ৪৮ ও সোনাগাজীতে ৪টি স্থানে বাঁধ মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলম জানান, সরকারিভাবে যে সহায়তা গুলো পাওয়া যাচ্ছে এবং বেসরকারিভাবে যে সহযোগিতা করা হচ্ছে তা সমন্বয় করে পুনর্বাসনের কাজ চলমান রয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করা গেলেও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রথম পর্যায়ে পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১১০ টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। যা অল্প কিছুদিনের মধ্যে শেষ। বাকিদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে আছে ধাপে ধাপে বরাদ্দ পেলে বাস্তবায়ন হবে।
তিনি আরও বলেন, এখনও বিভিন্ন এনজিও তালিকা চাচ্ছে। রেড ক্রিসেন্ট ১৯০ টি ঘর করে দেবে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো প্রায় মেরামত শেষ। এরপরেও বাকি থাকলে আবেদনের প্রেক্ষিতে করে দেয়া হবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পাইলটিং প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের শুধুমাত্র সরকারিভাবে দেয়া হচ্ছে এমন না। অনেক এনজিও সংস্থা, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ঘর নির্মাণের কাজ করছে। সরকারি পুনর্বাসন কাজ অনেক লম্বা প্রক্রিয়া কারণ রাস্তাঘাট স্কুল কলেজ সবগুলো বাস্তবায়ন করতে হয়। এরমধ্যে ১১০ টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। যে সকল এনজিও কাজ করছে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে ঘর গুলোর কাজ চলমান রয়েছে। এ ১১০ টি কাজ শেষ হলে বেসরকারিভাবে নির্মিত সবগুলো যাচাই করে যেগুলো বাকি থাকবে সেগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে।