অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে আভাস দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে নিয়ে প্রস্তুতি চলছে।
তবে ‘শেখ হাসিনার বিচারের আগে কেউ যেন নির্বাচনের কথা না বলে’-জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের এমন মন্তব্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে আবারও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়ায় জানা যাচ্ছে, তারা কেউই সারজিস আলমের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘বিচার একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিচারপ্রক্রিয়া সময়সীমার মধ্যে বেঁধে দেওয়া যায় না। বিচারের জন্য যেকোনো সময় লাগতে পারে। বিচার করতে পাঁচ বছর, ছয় বছর, বিশ বছরও লাগে অনেক সময়, এর সময়সীমা অনিশ্চিত। তবে নির্বাচন তো একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার ভেতরে হতে হবে। নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা যায় না। বিচারের সঙ্গে নির্বাচনের প্রসঙ্গ জুড়ে দেওয়া যুক্তিসংগত নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন থাকা দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। প্রজারা এর মালিক। তাদের এই মালিকানা স্বত্ব দিতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। জনগণের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একমুহূর্ত জনগণের ভূমিকা ছাড়া পরিচালনা করা উচিত না।’
জিএম কাদের মনে করেন, একজনের মতামতের ওপর এটা কখনো বসে থাকতে পারে না। নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা যা কিছু সংস্কার, পরবর্তী সময়ে দেশ পরিচালনা, জবাবদিহিমূলক সরকার- এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যত দ্রুত সম্ভব দিতেই হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি)’র সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচন না করে সংস্কার করা যাবে না। কারণ সংস্কার করতে গেলে জনগণের সম্মতি লাগবে। জনগণের প্রতিনিধিদের সম্মতি ছাড়া সংস্কার কার্যক্রম দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য সেসব সংস্কার অপরিহার্য, সেগুলো নির্বাচনের আগেই করতে হবে। আর অন্য সংস্কার নির্বাচনের পরেই করতে হবে।’
‘সুতরাং ডিসেম্বরের আরও আগেই নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। কারণ স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পরই সাহাবুদ্দিন সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়েছিল এবং একটি টাক্সফোর্স গঠন করে সুপারিশমালা তৈরি করেছিল। যদিও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। তার পরও তিন মাসের জায়গায় দেড় বছর অনেক সময়’-যোগ করেন তিনি।
রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হতে হলে তরুণদের নীতি-আদর্শের পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে উল্লেখ করে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আমরা মনে করি, সব অপরাধীর বিচার হওয়া উচিত। শুধু আওয়ামী লীগ কেন, বিগত সময়ে যারা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার হতে হবে। এখন কোটি কোটি টাকা খরচ করে দল গঠন করা হচ্ছে, সেই টাকার উৎস কী? মার্সিডিজ গাড়ি কোথা থেকে আসে? সবকিছুরই বিচার হওয়া উচিত। কোনো অন্যায়কারীর বিচার বাইরে থাকা উচিত নয়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিচারের সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা যদি আইনের প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনার শাস্তি এখনো হবে, তখনো হবে, তার পরও হবে। শেখ হাসিনার নামে অনেকগুলো মামলা রয়েছে, এগুলো বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটার পর একটার সমাধান হতেই থাকবে। সুতরাং বিচারিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।’
তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে আসেন, আলোচনা-বিতর্ক হবে, এরপর পাস হবে। সোজা কথা, ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সিদ্ধান্ত আসবে, তাতে কারও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি প্রস্তাব করছি, সুতরাং এটা হতে হবে, এই ধরনের মনমানসিকতা যদি থাকে, তাহলে তো শেখ হাসিনার মনোভাবকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আগামী নির্বাচনে জনগণ যদি ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে সেগুলো বাস্তবায়িত হবে। দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের অবশ্য মনে করেন আ.লীগের বিচার এবং নির্বাচন একসঙ্গে চলবে। তিনি বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। সংস্কার যেন অতিদ্রুত হয় সেটাও আমরা দাবি করেছি। সুতরাং ন্যূনতম সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছি। এটা আমাদের দলের অবস্থান। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিচার এবং নির্বাচনের আয়োজন- দুই-ই একসঙ্গে চলা সম্ভব। যদি সরকার সিরিয়াস (গুরুত্ব) সহকারে যথাযথ দায়িত্বের সঙ্গে এসব করে, তাহলে সম্ভব।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ছাত্ররা বুঝে না বুঝে অনেক কিছু বলছে এবং দেখাচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগের বিচারের কথা বলেছে, তাতে কি সরকারের সিদ্ধান্ত বদলেছে? সব সময় যৌক্তিক কথা বলতে হবে। নির্বাচন বন্ধ থাকবে, এটা কোনো কথা হতে পারে না।’
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব জানিয়ে এই রাজনীতিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচার করে রায় দেওয়া সম্ভব নয়। আইনি বা বিচারিক প্রক্রিয়া অনেক লম্বা সময়। আমি মনে করি, ডিসেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিচার করা, ফাঁসি বা সাজার রায় দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে বিচারের প্রাথমিক ধাপ শুরু করা যেতে পারে।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘এ সরকার আওয়ামী লীগের বিচার শেষ করে যেতে পারবে না। তবে আমরা আশা করি, এই সরকার আওয়ামী লীগের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। যদি বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচন নিয়েও কোনো বিতর্ক থাকবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাস চলে গেছে। তাদের আওয়ামী লীগের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত। তারা যদি এই বিষয়টি অবহেলা করে, তাহলে হয়তো বিচার দীর্ঘসূত্রতায় চলে যাবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘গণমাধ্যমে নির্বাচনের সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়ার যে বক্তব্য এসেছে, তাকে আমরা পুরোপুরি সঠিক মনে করি না। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের বিচারের কার্যক্রম দৃশ্যমান এবং কার্যকর হলে সবার জন্যই নির্বাচন সুবিধাজনক হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন আর ঘটবে না। তবে বিচারিক প্রক্রিয়া তার (নিজস্ব) গতিতে চলবে। এখানে কোনো রাজনৈতিক দল বিচারব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ করুক তা আমরা চাই না।’