ভ্যানচালক আশরাফুল ইসলাম যখনই কোথাও বের হতেন, তখনই স্ত্রী হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কখনোই চোখের আড়াল করেননি প্রিয় স্ত্রীকে। অথচ, শেষ পর্যন্ত সেই স্ত্রী হাসিনার মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার করল পুলিশ। আর তার স্বামী আশরাফুল ইসলাম পলাতক। তার ঘর থেকে রক্তাক্ত পোশাক উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) বিকেলে মৃত হাসিনার পরিচয় শনাক্তের পর আশরাফুলের বাড়ি থেকে তার রক্তাক্ত পোশাক উদ্ধার করা হয়। হাসিনা বেগম ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের কুটিবাড়ি গ্রামের ভ্যানচালক আশরাফুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি পাশের দেশ ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার হরিরহাট ইউনিয়নের জারিধল্লা গ্রামের কাশেম আলীর মেয়ে।
দ্বিতীয় সংসারেও নির্মম পরিণতি
পুলিশ ও প্রতিবেশীরা জানায় , ২০ বছর আগে প্রেম করে ভারতীয় নাগরিক হাসিনা বেগমকে বিয়ে করেন আশরাফুল ইসলাম। পরে হাসিনা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তাদের সংসারে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু প্রথম স্ত্রী মেহেরুন বেগমের চাপে সংসার ছাড়তে হয় হাসিনাকে। পরে দুর্গাপুর ইউনিয়নের শঠিবাড়ি গ্রামের নূর ইসলামকে বিয়ে করেন তিনি। সেই সংসারেও একটি কন্যা সন্তান জন্মের মাত্র দুই বছরের মাথায় তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
এরপর হাসিনা আবার আশরাফুলের সংসারে ফিরে আসেন এবং নতুন করে বিয়ে করেন। তাদের নতুন সংসারেও আরও একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। সেই থেকে হাসিনা ছিলেন আশরাফুলের ঘরেই।
প্রেম, বিরোধ আর নির্মম হত্যাকাণ্ড
আশরাফুল-হাসিনা দম্পতি তাদের প্রথম কন্যার বিয়ে দেন সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ফুলগাছ গ্রামে। প্রথম স্ত্রী মেহেরুন বেগমের সঙ্গে প্রায়ই বিবাদ হলেও স্বামীর ভালোবাসায় হাসিনার মুখে হাসি লেগেই থাকত। গ্রামবাসীর কাছেও তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। প্রথম স্ত্রী মেহেরুন ছিলেন রাগী স্বভাবের। তাই বিবাদ এড়াতে আশরাফুল প্রায় সময় হাসিনাকে সঙ্গে রাখতেন। দুই সংসার পাশাপাশি হলেও আশরাফুল থাকতেন ছোট স্ত্রী হাসিনার ঘরেই। বাজার খরচ দুই সংসারে সমানভাবে বণ্টন করলেও হাসিনার প্রতি তার ছিল বাড়তি ভালোবাসা, যা সহ্য করতে পারতেন না মেহেরুন। মেহেরুনের ঘরে চারটি ছেলে সন্তান রয়েছে।
গ্রামবাসীরা আশরাফুল-হাসিনার প্রেমের গভীরতা দেখে তাদের "সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের তাজমহলের প্রেম" বলে তুলনা করতেন। প্রায় দিন হাসিনাকে ভ্যানে করে নিয়ে ঘুরতেন আশরাফুল। সোমবার বিকেলেও স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। এরপর থেকে আর হাসিনার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বুধবার দুপুরে সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ফুলগাছ গ্রামে একটি ভুট্টাক্ষেত থেকে মাথাবিহীন এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পরিচয় শনাক্ত, স্বামী পলাতক
বৃহস্পতিবার সকালে হাসিনার এক আত্মীয় তাকে খুঁজতে এসে না পেয়ে সন্দেহ করেন। এরপর সদর থানায় গিয়ে খবর পেয়ে জানতে পারেন, উদ্ধার হওয়া মাথাবিহীন লাশটিই হাসিনার।
এরপর পুলিশ ক্লু উদ্ধারে হাসিনার বাড়িতে অভিযান চালায়। তবে এর আগেই আশরাফুল ইসলাম পালিয়ে যান। পুলিশ তার ঘর থেকে রক্তাক্ত পোশাক এবং তার প্রথম স্ত্রী মেহেরুনের বাবার বাড়ির পাশের একটি তালাবদ্ধ ঘর থেকে আরও কিছু পোশাক উদ্ধার করে। তবে হাসিনার মাথা উদ্ধার এবং আশরাফুলকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই আশরাফুল, তার প্রথম স্ত্রী মেহেরুনসহ পরিবারের সবাই পলাতক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসিনার এক প্রতিবেশী বলেন, "হাসিনাকে ভ্যানে নিয়ে বের হলেও ফিরেছেন একা। বুধবারও হাসিনা ছাড়া তার ঘরেই ছিলেন আশরাফুল। বৃহস্পতিবার সকালে প্রথম স্ত্রীসহ তামাকক্ষেতে কাজ করেন। পুলিশ আসার আগেই সবাই পালিয়েছে। আশরাফুল-হাসিনার প্রেম ছিল গভীর। এত ভালোবাসার মানুষকে সে কীভাবে হত্যা করল! এটা বোধগম্য নয়।" তিনি আরও বলেন, "এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড আশরাফুল একা ঘটাতে পারে না। সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।"
"তাজমহলসম প্রেমের এমন পরিণতি!"
দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, "আশরাফুল-হাসিনার প্রেম ছিল সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের মতোই গভীর। কোথাও গেলে আশরাফুল ভ্যানে হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তাদের ভালোবাসা দেখে সবাই মুগ্ধ ছিল।" তিনি আরও বলেন, "কিন্তু আজ হাসিনার মাথাবিহীন লাশ পড়ে আছে, আর আশরাফুল পলাতক! এত গভীর প্রেমের পরিণতি এমন বীভৎস হতে পারে? নিশ্চয়ই আশরাফুল জানে, হাসিনা হত্যার আসল রহস্য কী!"
লালমনিরহাট সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) বাদল চন্দ্র বলেন, "হাসিনার জাতীয় পরিচয়পত্র ও আঙুলের ছাপ দিয়ে তার পরিচয় নিশ্চিত হয়েছি। এ ঘটনায় লাশ উদ্ধার হওয়া ভুট্টাক্ষেতের মালিক শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।" তিনি আরও বলেন, "হাসিনার ঘর তল্লাশি করে তার স্বামী আশরাফুলের রক্তাক্ত জ্যাকেট ও শার্ট উদ্ধার করা হয়েছে। আশরাফুল পলাতক থাকায় তাকে আটক বা মাথাটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আশরাফুলকে পেলেই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হবে এবং মাথাও উদ্ধার করা যাবে।"