মডেল পিএসসি-২০২৩ (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি) আরও আকর্ষণীয় করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ আরও কিছু বিষয়ে ছাড় দেওয়া হতে পারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সুত্র জানিয়েছে।
পেট্রোবাংলার পরিচালককে (পিএসসি) প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে করণীয় নির্ধারণে সুপারিশ জমা দিতে বলা হয়েছে। গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ৭টি কোম্পানি দরপত্র কিনলেও জমা দেয়নি কেউই। কারণ চিহ্নিত করতে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি দরপত্র গ্রহণকারি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
ওই কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য ৪ মার্চ বৈঠকে বসে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে রিপোর্ট পর্যালোচনা শেষে করণীয় নির্ধারণের সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে।
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগের কমিটি কারণ চিহ্নিত করেছে। আর এই কমিটিকে করণীয় নির্ধারণে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। সুপারিশ পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, প্রয়োজন হলে পিএসসি আপডেট করা হতে পারে।
বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে ২৪টি ব্লকে (গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯টি) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হয় চলতি বছরের ১১ মার্চ। দরপত্র জমার জন্য ৬ মাস (৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সময় দেওয়া হয়। সময় শেষ হওয়ার আগেই ৩মাস বাড়িয়ে ৯ ডিসেম্বর করা হয়।
মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি এবং ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল শেভরন, এক্সনমবিল, ইনপেক্স, সিনুক ও জোগোম্যাক। ৭টি কোম্পানি দরপত্র গ্রহণ করলেও নির্ধারিত সময়ে কেউই জমা দেয়নি। পেট্রোবাংলা আরেক দফায় ৩ মাস সময় বাড়ালেও কোন লাভ হয় নি।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, এক্সন মবিল দু’টি বিষয় সামনে এনেছে, এগুলো হচ্ছে গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগে আনা পাইপলাইনের খরচ হিসেবে সঞ্চালন চার্জ না রাখা এবং ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) নিয়ে আপত্তি। বিদ্যমান আইনে কোম্পানির মুনাফার ৫ শতাংশ ডব্লিউপিপিএফ এ হস্তান্তরের বিধান রয়েছে। যা নিয়ে মার্কিন কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপোড়েন চলে আসছে।
দরপত্র কিনলেও জমা না দেওয়ার তালিকায় ছিল শেভরন বাংলাদেশও। তারা তাদের প্রস্তাবে ডব্লিউপিপিএফ নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল কর্পোরেশন (সিএনওওসি) তার জবাবে লিখেছে, পেট্রোবাংলা তাদের ডাটা বিক্রির জন্য যে প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করেছিল, তার দর অনেক বেশি ছিল। গ্যাসের দাম কমিয়ে রাখার বিষয়টিও সামনে এনেছে একটি কোম্পানি। তাদের দাবি হচ্ছে পিএসসি চুড়ান্ত করণ কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান দামের যে সুপারিশ দিয়েছে, তা রাখা হয় নি।
বিশাল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পুর্বেই ৭টি বহুজাতিক কোম্পানি দরপত্র কিনলেও শেষ পর্যন্ত জমা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। কারণ জানতে পরিচালককে (পিএসসি) প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরিচালক পিএসসি আলতাফ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা প্রত্যেকটি কোম্পানিকে মেইল করে তাদের মতামত রিপোর্টে তুলে ধরেছি।
সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি আপডেট করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্য আকর্ষণীয় করা হয় পিএসসি (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি)। আগের পিএসসিতে গ্যাসের দর স্থির করা দেওয়া হলেও এবার ব্রেন্ট ক্রডের দরের সঙ্গে মিল করে দেওয়া হয়। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ দরের সমান। যা আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল। দামের পাশাপাশি বাংলাদেশের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও কোন আগ্রহী প্রতিষ্ঠান না পাওয়াটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মডেল পিএসসি ২০০৮ প্রণয়ন কমিটির প্রধান মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, অনেকে মনে করেছিলেন গ্যাসের দাম বাড়ালেই কোম্পানিগুলো দৌড়ে আসবে। সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেনো জমা হয়নি সেটা তালাশ করার পাশাপাশি কেনো মাত্র ৭টি কোম্পানি দরপত্র কিনেছে সেটাও দেখা দরকার। পিএসসিতে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে, এখানে শর্ত দেওয়া হয়েছে দৈনিক ২০ হাজার ব্যারেল (তেলের সমান) গ্যাস উত্তোলন করে এমন কোম্পানি দরপত্র কিনতে পারবে। এখানেইতো অনেক কোম্পানি বাদ পড়ে গেছে। আমি মনে করি গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ১০ হাজার এবং অগভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ৫ হাজার ব্যারেল হওয়া উচিত। তাহলে আরও অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিতে পারবে।
তিনি বলেন, আমরা যখন ২০০৮ সালে পিএসসি প্রণয়ন করি তখন ১৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দিতে যাচ্ছিলাম। একটি বিদেশি কোম্পানি এসে আমাদের বললো ২৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দেওয়ার জন্য। আমরা রাজি না হলেও মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ হাজার করা হয়েছিল। আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ডাটা প্যাকেজের দাম অনেক বেশি। কোন কোন প্যাকেজের দাম মিলিয়ন ডলারের মতো। অন্য দেশে এসব ডাটা ফ্রি দেয়। ১৯৭৪ সালে আমাদের দেশে এসব ডাটা উন্মুক্ত ছিলো, তখন অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিয়েছিলো।
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা আসলে ডাটার ব্যবসা করবো, নাকি গ্যাস দরকার। সেটা আগে চিহ্নিত করা দরকার। ডাটার দাম এতো রাখার কোন যৌক্তিকতা দেখি না।
পেট্রোবাংলা সুত্র জানিয়েছে, গ্যাসের দর, পাইপলাইনের হুইলিং চার্জ এবং ডাটা প্যাকেজের দামের বিষয়টি সামনে এসেছে। এগুলো খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব। আগের মতো পুরো ড্রাফট আর দেখতে হচ্ছে না। আন্তরিকভাবে কাজ করলে ৩ মাসের মধ্যে আপডেট করা সম্ভব।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৮টি গ্রাহক শ্রেণিতে দৈনিক অনুমোদিত লোড রয়েছে ৫ হাজার ৩৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট, (দৈনিক) এর বিপরীতে চাহিদা ধারণা করা হয় ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, আর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিলিয়নের মতো। বেশি চিন্তার হচ্ছে মজুদ কমে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত দেশীয় গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন উৎপাদন হলেও এখন ১৯০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। ঘাটতি সামাল দিতে চড়াদামে আমদানি করতে গিয়ে চরম সংকটে পড়েছে পেট্রোবাংলা। দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে।