সংস্কারে উপেক্ষিত নারী, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যু
১.
সরকার পরিবর্তনের পর সংস্কারের ঢেউ চলছে। কয়েকটি কমিশনও গঠিত হয়েছে। কর্তৃত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদের পুরনো প্রেতাত্মাদের তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে সরকার ও প্রশাসনের সর্বত্র। এতো কিছুর পরেও বলা হচ্ছে, 'যারা এখন দেশ পরিচালনা করছেন তাদের কারোরই দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। তারা সবাই এনজিও পরিচালনা করেছেন।' এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। আরও এক ধাপ এগিয়ে 'ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শুধু সরকার পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছুই বদলায়নি' বলে দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
রাজনীতিবিদদের 'কিছুই বদলায়নি' ধরনের প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি সংস্কারের আওতায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হওয়ার নাগরিক সমাজও সরব। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু, রোহিঙ্গা শরণার্থীর মতো স্পর্শকাতর ইস্যুসমূহ।
২.
ছাত্র-জনতার এবারের অভ্যুত্থানে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ নারীর রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যায়। গণ–অভ্যুত্থানের পর নারীর প্রতি বিরাজমান সব বৈষম্য দূর করার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, তা নিয়ে যৌথ কলাম লিখেছেন ফারহানা হাফিজ, শাম্মিন সুলতানা, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও সাবিনা পারভীন। তাঁরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, তা হলো ‘সংস্কার’। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় খুব আলোচনা হচ্ছে, তা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা। কিন্তু ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে আমরা দেখছি, বেশির ভাগ উদ্যোগ ও আলোচনা থেকে নারী এবং আন্দোলনের নারী সমন্বয়কেরা যেন ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্র সংস্কারের আলাপ পারবে কি রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্ত ও সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫১ শতাংশ নারীর হিস্যা ও অংশীদারত্বের বিষয়টি সমস্বরে উচ্চারণ করতে? পারবে কি নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে সংস্কারের দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে?
এই মর্মে প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে যে, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন করে তাঁর সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা কি পূর্ণভাবে প্রস্তুত? আমরা আশাবাদী হতে চাই আর তাই আমরা মনে করি, সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ এবং কণ্ঠস্বর নিশ্চিত করতে চলমান সংস্কারব্যবস্থায় শিগগিরই একটি ‘নারী অধিকার কমিশন’ গঠন করা উচিত। এর মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের নারীদের কাছ থেকে দেশ গঠনে তাঁদের মতামত নেবে এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে।
৩.
সংস্কারব্যবস্থায় দ্রুতই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিশন' গঠনের কথাও নানা ফোরামে উত্থাপন করেছেন সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং জাতিগত সংঘাত ও শান্তি নিয়ে সক্রিয় বিশেষজ্ঞগণ। যে কমিশনের মূল কাজ হবে: ক) ২৭ বছরে শান্তিচুক্তির প্রকৃত বাস্তবায়ন নিরীক্ষণ করা, খ) শান্তিচুক্তির ধারাগুলোকে পরিমার্জনাট মাধ্যমে সময়োপযোগী করা, গ) পাহাড়ি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মৈত্রী ও সম্প্রীতির রূপরেখা প্রণয়ন করা, এবং ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রাম ও জাতীয় নিরাপত্তার যোগসূত্রের ভিত্তিতে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা।
মনে করা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের গুরুত্বের তালিকায় সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টাকে নিয়েও রয়েছে এন্তার সমালোচনা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও স্তর থেকে পতিত সরকারের শেকড় উৎপাটনের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায় নি। যে কারণে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রাম উতপ্ত হয়ে পড়েছিল। যে ঘটনার পেছনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কথা খোদ সরকারের পক্ষেই বলা হয়।
তথ্য বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের ৬১ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণ করা হলেও রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যরা এখনো বহাল রয়েছেন। তবে তারা দপ্তরে অনুপস্থিত। যেমন, গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে রাঙামাটিসহ পার্বত্য তিনটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা গা ঢাকা দেন। আবার স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে অব্যহতির ঘোষণা দিয়েছেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইুপ্রু চৌধুরী। স্বাভাবিক কারণেই চেয়ারম্যান-সদস্যদের অনুপস্থিতিতে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের দাপ্তরিক, প্রশাসনিক, সেবা-পরিষেবাসহ পরিষদীয় সব কার্যক্রমে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
জানা যায়, সবশেষ ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে অংসুইপ্রু চৌধুরী, খাগড়াছড়িতে মংসুইপ্রু চৌধুরী ও বান্দরবানে ক্যশৈহ্লা মারমাকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। তিনটি পরিষদে মনোনীত এসব চেয়ারম্যান-সদস্য সবাই আওয়ামী লীগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষনেতা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির বিশেষ শর্তে প্রবর্তিত এ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পাঁচ বছর অন্তর তিন জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করার বাধ্যবাদকতা থাকলেও পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী কোনো সরকারই নির্বাচনের পদক্ষেপ নেয়নি।
চেয়ারম্যান-সদস্য পদে নিজস্ব লোকজনদের নিয়োগ দিয়ে পরিষদ তিনটি পরিচালনা করে আসছিল বিগত সরকারগুলো। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার মনোনীত চেয়ারম্যান-সদস্যদের অপসারণ করে পরিষদ তিনটি পুনর্গঠনের কথা শোনা গেলেও এ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। তবে ইতোমধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে অংসুইপ্রু চৌধুরী স্বেচ্ছায় অব্যাহতির ঘোষণা দিলেও অন্যরা এখনো বহাল আছেন, যদিও তারা আত্মগোপনে রয়েছেন।
৪.
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কমপক্ষে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটিও মনোযোগের দাবি রাখে। অতীতের সরকার রোহিঙ্গা বিষয়ক কোনও নীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হওয়ায় বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। মিয়ানমারে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের কারণে প্রায়-প্রতিদিনই নির্যাতিত রোহিঙ্গা পরিবার এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। সীমান্তের অপর দিক থেকে গোলাবারুদ এসেও পড়ছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের দূরত্ব ও উত্তেজনা বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে মানব, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ঝুঁকি এবং নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও রয়েছে ঘোরতর অনিশ্চয়তায়। ফলে পুরো বিষয়গুলোকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করার ও প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য একটি কমিশনের অপরিহার্যতা তাই অনস্বীকার্য।
অতএব, সংস্কারে উপেক্ষিত নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু, রোহিঙ্গা শরণার্থীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।