রাষ্ট্র সংস্কারে ৫টি কমিশন ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতি
রাষ্ট্র সংস্কারে ৫টি কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত ৫টি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর পর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ড. বদিউল আলম মজুমদারকে নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচারপতি শাহ আবু নাইমকে বিচার বিভাগ, সফর রাজ হোসেনকে পুলিশ সংস্কার, ড. ইফতেখারুজ্জামানকে দুর্নীতি দমন এবং আব্দুল মুয়িদ চৌধুরীকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে।
সন্দেহ নেই, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, পুলিশ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার জরুরি। তবে এগুলো যথেষ্ট নাকি আরও কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার করা দরকার, তা নিয়ে নানা মহলে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। বিশেষত, জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থ ও ব্যাঙ্কিং এবং শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার না করা হলে রাষ্ট্র সংস্কার পূর্ণতা পাবে কিনা সন্দেহ।
বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা নীতি যদি থাকে তাহলে সেটাকে সংস্কার করার দরকার আছে কিনা এবং না থাকলে তার রূপরেখা প্রণয়ন করার মতো অত্যাবশীয় বিষয়টি মোটেও উপেক্ষা করা যায় না। তাছাড়া বিদ্যমান সংবিধানে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা-ভাবনার দরকার আছে। কারণ, অতীতে বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণের মাধ্যমে দুর্বল ও বিতর্কিত করা হয়েছিল, সশস্ত্র বাহিনীকে যেন তেমনটি করা না যায়। সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পেশাগত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পরিচালিত করার সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যেই জরুরি। এ কারণে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ তথা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর ভারসাম্যপূর্ণ সাংবিধানিক সম্পর্ক এমনভাবে সুনিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভবিষ্যতের কোনও দল, সরকার বা ব্যক্তি জাতীয় নিরাপত্তা ও নিরাপত্তার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানকে দলীয় বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে না পারে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বিগত জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের রাজনৈতিক আন্দোলন ও ক্ষমতার পালাবদলের উতপ্ত পরিস্থিতিতে প্রায়-সকল সরকারি সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজনৈতিক ও দলীয় পক্ষপাতের কারণে নৈতিকভাবে পর্যদস্তু ও ভঙ্গুর অবস্থার সম্মুখীন হয়। তখন একমাত্র সশস্ত্র বাহিনীই সকলের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক রূপে দেশ ও জাতিতে চরম সংকুল পরিস্থিতি ও বির্পযয় থেকে উদ্ধার করে এবং জন ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অতএব জাতীয় নিরাপত্তা ও সশস্ত্র বাহিনীর বিষয়টি দল ও রাজনীতির ঊর্ধে সমুন্নত রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নীতি প্রণয়নের পথে অগ্রসর হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যাতে কখনোই কোনও নেতা বা দল রাজনীতি বা দলীয় প্রভাবের দ্বারা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কীত এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রভাবিত বা আক্রান্ত করতে সফল না হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের মজবুত নিরাপত্তা নীতি ছিল কিনা, তা-ও এক জরুরি প্রশ্ন। থাকলে বাংলাদেশকে বিশেষ কোনও দেশ বা পক্ষের অনুগত বলে প্রচার করা সম্ভব হতো না। বাংলাদেশের উপর পনের লক্ষ মিয়ানমারের নাগরিককে (রোহিঙ্গা) চাপিয়ে দেওয়া এবং তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দীর্ঘ সাত বছর ধরে অমীমাংসিত রেখে দেশের জন্য সীমাহীন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করাও সম্ভব হতে পারতো না। তদুপরি পার্বত্য চট্টগ্রামে লাগাতার অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে জন ও জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারতো না দেশি-বিদেশি সুযোগ সন্ধানী মহল। এ কারণেই সংস্কার বা ইতিবাচক পরিবর্তনের পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে উদ্যোগহীনতা মোটেও কাম্য নয়।
ফলে অতীতের কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী শাসনে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তারা কি কি ভুল ও ভ্রান্তি করেছিল, সেটা স্পষ্টভাবে আলোচিত ও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনী সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ব্যাপারে সক্রিয় হওয়ারও তাগিদ দেয়। প্রসঙ্গত, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি ঢেলে সাজানো ও সংস্কার করা আরও জরুরি এজন্য যে, বাংলাদেশের সীমান্তের পাশে ভারতের সেভেন সিস্টারস নামক রাজ্যগুলোতে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে এবং আরেক সীমান্তবর্তী মিয়ানমারে অব্যাহত রয়েছে চরম গৃহযুদ্ধ। এসব ঘটনার কারণে বাংলাদেশেও নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারীদের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশেই। বিচ্ছিন্নবাদীরা এক দেশের সীমান্ত পেরিয়ে আরেক দেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমানের সীমান্তরেখার পাশেই অবস্থিত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের নিরাপত্তা ঝুঁকি এসব বাস্তব কারণে বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচারের ঘটনাও।
স্থল সীমান্তের মতোই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমান্ত নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচারের বিষয়গুলো সমুদ্রপথেও আকছার ঘটছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অপরাধী ও সন্ত্রাসী চক্র স্থলপথের পাশাপাশি জলসীমান্তেও সক্রিয়। তদুপরি, বঙ্গোপসাগর হলো ভারত মহাসাগর ও ইন্দো-প্যাসিফেকের প্রান্তিক এলাকা, যেখানে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এসে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। বিশাল এই সমুদ্র অঞ্চল বর্তমান বিশ্ব পরাশক্তিসমূহের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এমনই কৌশলগত অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে নিরাপত্তাগত দিক থেকে সর্বদা সতর্ক থাকার বিষয়টি মোটেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বরং একটি টেকসই নিরাপত্তা নীতি এবং পেশাগত সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সামরিক ও অসামরিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো কৌশলে সুদক্ষভাবে নিয়ন্ত্রক ও মোকাবেলা করতে পারে। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে গভীর মনোযোগ ও গুরুত্বের দাবি রাখে।
একবিংশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তি যুগে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে অগ্রসর ও টেকসই কৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ বা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট নিশ্চিত করতে বিশ্বের প্রতিটি দেশই সচেতন ও সচেষ্ট। বাংলাদেশকেও এক্ষেত্রে সক্রিয় হতে হবে। বিশেষত অতীতের কুশাসনে নানা ক্ষেত্রের মতো জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে কি কি ক্ষতি ও ভুল করা হয়েছে, সেগুলো দেশ ও জাতির স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার ও সংশোধন করার কোনও বিকল্প নেই।
যদিও জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান দৃশ্যত ব্যাপক আকারের রাজনৈতিক কর্মসূচি ভিত্তিক ছিল না এবং এর পেছনে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিও ছিল না। এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, যাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতির নানা দল, মত, পেশা ও গোষ্ঠীর সমর্থন ঘোষিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য সফল গণবিপ্লবের সঙ্গে তুলনায় জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান বিপ্লব, বিদ্রোহ, গণঅভ্যুত্থান, পরিবর্তন কিনা সেটা স্পষ্ট হবে আন্দোলনের নেতৃত্বের নীতি ও কার্যক্রমের ভিত্তিতে। তবে, গতানুগতিক রাজনীতির চেয়ে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান গুণ ও বৈশিষ্টগত অর্থে আলাদা, যা অনেক গবেষক উল্লেখ করেছেন এবং আমি নিজেও Student Protest and Hasina’s Downfall in Bangladesh: Causes and Consequences (Dhaka: Student Ways, August, 2024) গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। ফলে জুলাই-আগস্টের বাংলাদেশ যে স্বপ্ন নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের রক্ত-রঞ্জিত পথের সূচনা করেছে, তা ইতিবাচক পরিবর্তন ও গুণগত সংস্কার এবং একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নিরাপত্তা নীতি ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার পটভূমিতে ‘ফ্যাসিবাদ-কর্তৃত্ববাদ-মুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা’র অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে না।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।