শারমিন সেঁজুতি রহমান (২৮)। ঢাকার পান্থপথের একটি তারকা হাসপাতালে গাইনী বিভাগের চিকিৎসকদের নিয়োমিতচেক আপে ছিলেন তিনি। সন্তান জন্মদানের সময় ঘনিয়ে আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই ঘটলো দুর্ঘটনা। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো করোনায় আক্রান্ত হলেন তিনি। গোটা পরিবার পড়লো দুর্ভাবনায়। তবে করোনায় তেমন শারীরিক জটিলতা না থাকায় বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। সমস্যা হলো সন্তান জন্মদানের সময় ঘনিয়ে আসায়। চিকিৎসকের পরামর্শে নির্ধারিত তারিখে শারমিন সেঁজুতি রহমানকে নেয়াহয় ওই তারকা হাসপাতালে।
কিন্তু করোনায় আক্রান্ত শুনেই তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। নিয়মিত আসা সেই হাসপাতালের চেনা পরিবেশ হঠাৎ অচেনা হয়ে ওঠে পরিবারটির কাছে । সে সময় প্রসব বেদনায় ছটফট করছেন প্রসূতি মা। কিন্তু কোন উপায় নেই। শেষমেষ পারিবারিক এক চিকিৎসকের পরামর্শে অভিজাত ধানমন্ডির এই বাসিন্দা ছুটলেন সাভারে, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকরা গভীর মমতায় স্বাগত জানালেন সেঁজুতিকে। কঠোর সর্তকর্তার সাথে জরুরি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলোর মুখ দেখলো নবজাতক। তারপরই চিকিৎসকদের শুরুহলো নবজাতকদের সুরক্ষা আর সেঁজুতি কে করোনা থেকে মুক্ত করার নতুন যুদ্ধ। কেবল শারমিন সেঁজুতিরহমানের ঘটনাই নয়, এমন শত অভিজ্ঞতা নিয়ে কোভিড হাসপাতাল চালুর মাস পূর্তি করলো এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বলছিলেন হাসপাতালটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. আনোয়ারুল কাদের নাজিম।
পরিকল্পিত সময়ের এক মাস আগেই বলতে পারেন আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে করোনা ইউনিট চালু করেছি। যার নেপথ্যে ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠাতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান স্যারের ভিশন, মিশন ও ডেডিকেশন- বলছিলেন ড.নাজিম।
কোভিড চিকিৎসা নিয়ে যখন চারপাশে বেরিয়ে আসছে প্রতারণা, নানান অনিয়ম আর পিলে চমকানো তথ্য তখন নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় সাভারে মাইলফলক পার করলো এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
আনুষ্ঠানিক ‘কোভিড’চিকিৎসার শুরুর একমাসে চার হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মুমূর্ষু অবস্থা থেকে ৩০০ এর বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। আর প্রকৃত সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে এই সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন ৪০ জন নিবেদিত প্রাণ চিকিৎসক, ৬০ জন নার্সসহ দুই’শ স্বাস্থ্য কর্মী। যাদের সবাই স্বাস্থ্য বিধি মেনে ১৫ দিনকাজ করে অবশিষ্ট ১৫ দিন আইসোলেশনে থাকছেন। এর বাইরে দেশ সেরা অধ্যাপক, ল্যাব ইনচার্জসহ ২০ জন অভিজ্ঞ টেকনেশিয়ান রয়েছেন সর্বাধুনিক পিসিআর (পলিমার চেইন রি-অ্যাকশন) ল্যাবেরদায়িত্বে। বাড়তি চাপ সামাল দিতে স্থাপন করা হয়েছে নতুন আরো একটি পিসিআর মেশিন।
যোগাযোগ করা হলে, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা.এনামুর রহমান বলেন, সরকার অনুমোদিত এই ল্যাবের নির্ভূল ফলাফলের জন্যে আমাদেরপ্রতি আস্থা রেখেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিদেশি কর্মী থেকে শুরু করে নানা শ্রেনি পেশার অসংখ্য মানুষ। তাদের এই সেবাকে আরো বিস্তৃত করতে আমরা নতুন আরো একটি পিসিআর মেশিন স্থাপন করেছে। যার কারণে রোগ নির্ণয়ে আমাদের সক্ষমতা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ইতিমধ্যে এই ল্যাবে আমরা চার হাজারের অধিক নমুনা পরিক্ষা করেছি। এই অতিমারী পরিস্থিতিতে করোনার মতো প্রাণঘাতি ঝুকিঁপূর্ণ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবায় সরকারের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যাতে একটি প্রাণ-ও আর ঝড়ে না যায়- সে বিষয়টি মাথায় রেখেই আমি করোনা ইউনিট চালু করি।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকেও জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। তিনি লিখেছেন, ছোটবেলায় আমি বাবা হারিয়েছিলাম। আমি জানি, অকালে একজন মানুষের মৃত্যু কিভাবে একটি পরিবারের স্বপ্নকে তছনছ করে দেয়। করোনা সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে কেড়ে নিয়েছে ৬০ জনের মতো খ্যাতিমান চিকিৎসকের প্রাণ। আক্রান্ত হয়েছেন চিকিৎসক,নার্সসহ অসংখ্য স্বাস্থ্য কর্মী। একদিকে ঝুঁকি অন্য দিকে বিশ্বের কাছে আনকোরা এই রোগের এখনো চিকিৎসা আবিষ্কৃত না হওয়ায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের করোনা নিয়ে নিয়োজিত করা ছিলো অত্যন্ত জটিল বিষয়। কারণ সবাই বাঁচতে চায়। সবার কাছেই জীবনের মূল্য অনেক বেশি।এই ক্ষেত্রে আমাদের হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড.আনোয়ারুল কাদের নাজিমের ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়। বলতে পারেন তার অদম্য চেষ্টা, মেধা আর পরিশ্রমে পরিকল্পিত সময়ের এক মাস আগেই চালু হয়েছে কোভিড ইউনিট।
কেবল ইউনিট করলেই তো হবে না, সংক্রমেণের সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা,তাদের বিশেষ প্রণোদনা- সব কিছু দিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি কাটিয়েও করোনা ডেডিকেটেড ইউনিট চালু রাখা হয়েছে- কারণ একটি প্রাণ-ও যাতে ঝড়ে না পড়ে সেটাই ছিলো আমাদের লক্ষ্য। চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্তরিকতা, যত্ন আর পরিচর্যায় তিনশ’য়ের বেশি রোগী করোনাকে জয় করে সুস্থ্যহয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছেন। এটাই আমাদের জন্যে পরম প্রাপ্তির- যোগ করেন ডা.এনাম।
এনাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনায় ২৫ জনের মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনেতিনি আরো বলেন, এটা আমাদের জন্যে দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। যাদের অধিকাংশই এসেছিলেন শেষ মুহূর্তে।
হাসপাতালের পরিচালক (জনসংযোগ) জাহিদুর রহমান জানান, করোনায় সংক্রমণটাই বড় ঝুঁকির। যে কারণে হাসপাতালের অন্যান্য রোগী থেকে কোভিড রোগীদের সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে রাখতে নির্মানাধীণ বহুতল একাডেমিক ভবনে ১’শ শয্যার ডেডিকেটেড কোভিড ইউনিটের কার্যক্রম চলছে। এর বাইরে রয়েছে আরো ৫০ শয্যার আইসোলেশন কেবিন।
তিনি জানান, হাসপাতালের সকল স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়োমিত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ভাইরাসটির সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে নেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা। উচ্চমাত্রায় জ্বর, কফ, গলাব্যথা হঠাৎ ঘ্রাণ ও স্বাদ হারিয়ে ফেলা করোনা আক্রান্তদের প্রাথমিক উপসর্গ হলেও উপসর্গহীন রোগীর কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য কর্মীরা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে মারা গেছেন হাসপাতালের ডায়বেটোলজিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ডা. রফিকুল হায়দার (৫২)। আক্রান্ত হয়েছেন আমাদের হাসপাতালের অধ্যক্ষ, চিকিৎসক, পরিচালকসহ অনেক স্বাস্থ্য কর্মী।
প্রসঙ্গত ১৯৮২ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন ডা. এনামুর রহমান। সাভারে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যোগ দিয়েই বদলে ফেলেন সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ধারা। ক্রমেই জনপ্রিয় চিকিৎসক হয়ে ওঠেন তিনি। মানুষদের ভালোবাসা আর আন্তরিকতার টানে ছেড়ে দেন সরকারি চাকরি। ১৯৮৯ সালে একটি ভাড়া বাসায় চালু করেন এনাম ক্লিনিক নামে ছয় শয্যার একটি ছোট ক্লিনিক। মানুষের আস্থা আর নির্ভরতায় ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করি এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। যা এখন এক হাজার শয্যার অন্যতম এদেশ সের বিশাল বেসরকারি হাসপাতাল। ২০১৩ সালে বিশ্ব কাঁপানো রানা প্লাজা ধসে আমাদের চিকিৎসা সেবা দেশে বিদেশে ব্যাপক ভাবে প্রশংসিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এনাম মেডিকেল কলেজ আজ দেশ সেরা অন্যতম বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর পাশাপাশি এনাম নার্সিং কলেজে মিডওয়াইফারি, ডিপ্লোমা, পোষ্ট ব্যাসিক আর বিএসসি নার্সিং কোর্স চালুরমাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ মানের এনাম হার্টসেন্টার থেকে এনাম ক্যান্সার ইউনিট। এমন অসংখ্য বিভাগের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজিত ডেডিকেটেড ‘কোভিড ইউনিট’ স্থাপন করে অসংখ্য মানুষের প্রাণ রক্ষায় নিবেদিত ভাবে কাজ করছে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও এনাম নার্সিং কলেজ।