সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পার্শ্বে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাগলা ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামে শত বছরের পুরনো স্থাপত্য নিদর্শন, মোগল প্রাসাদাকৃতির তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটি দেখতে পাওয়া যায়। মহাশিং নদীর কুল ঘেঁষে রাজকীয় মহিমায় দাড়িয়ে আছে স্থাপত্যকলার বিস্ময় হয়ে থাকা এই নিদর্শনটি।
মূলত নির্মাণশৈলী ও অপূর্ব কারুকাজের জন্য এই মসজিদটি বিখ্যাত। এলাকায় এই মসজিদ রায়পুর বড় মসজিদ নামেও পরিচিত।
এলাকার ব্যবসায়ী ইয়াসীন মির্জা। ব্যবসা উপলক্ষে তিনি ভারতের কলকাতাসহ নানা জায়গায় ভ্রমণ করতেন। ভ্রমণের সুবাদে বিভিন্ন জায়গার স্থাপত্যশৈলী দেখে তিনি এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৩১ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। টানা দশবছর কাজ চলে। ইয়াসিন মির্জা ব্রিটিশ রাজের শহর কলকাতা ও দিল্লি থেকে স্থপতি ও নির্মাতা আনিয়েছিলেন। প্রধান স্থপতি ছিলেন মুমিন আস্তাগার, তিনি তাজমহলের স্থপতিদের একজনের বংশধর ছিলেন। এই সময়কালে মুমিন ঢাকাতে বসবাস করতেন।
দোতলা এই স্থাপনাটি কোনো ধরনের রডের ব্যবহার ছাড়াই সম্পূর্ণ ইটের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। দোতলা এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার, প্রস্থ ৫০ মিটার। গম্বুজের উচ্চতা ২৫ ফিট, দেয়ালের পুরুত্ব ১০ ফিট। মসজিদের ৩টি গম্বুজ ও ৬টি সুউচ্চ মিনার রয়েছে। দোতলা এই ভবনের সামনে একটি বড় ঈদগাহ আছে। উত্তর দিকে একটি ফটক আছে। তৎকালীন সময়ে নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ১০ লাখ টাকা।
নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থান দোতলায়। সেখানকার মেঝে ও তার আশপাশে কারুকাজ রয়েছে। মসজিদের দু’তলার মেঝেতে রয়েছে দুর্লভ শ্বেতপাথর, তার চারপাশে ব্লকে দেওয়া ব্ল্যাক স্টোন বা কালোপাথর তো আরও বেশি দুর্লভ। এগুলো আনা হয়েছে ভারতের জয়পুর থেকে। তখনকার অবিভক্ত ভারতের সঙ্গে নদীপথের যোগাযোগ বেশ সহজ ছিল।
মসজিদে ব্যবহৃত এই জাতের পাথর একমাত্র তাজমহলে ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা যায়।
মসজিদের মিহরাব অংশে জমকালো পাথর কেঁটে আকর্ষণীয় নকশা করা হয়েছে। পুরো মসজিদের চারপাশে তিন ফুট উচ্চতা পর্যন্ত যে কারুকার্য খচিত টাইলস লাগানো হয়েছে, সেটি উঁচুমানের স্থাপত্যশৈলীর ইঙ্গিত দেয়। টাইলসগুলো ইতালি, জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে আনা। প্রত্যেক প্রবেশদ্বারে পাথরখচিত খিলান মসজিদটিকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। মসজিদের দোতলার ছাদে রেললাইনের স্লিপার ব্যবহার করা হয়েছে। ছাদ ও গম্বুজের চারপাশে পাথর খোদাই করা পাতার ডিজাইন গ্রামীণ ঐতিহ্যের জানান দেয়।
মসজিদের ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ভূমি খনন করে বেশ মজবুত পাতের ওপর স্থাপনাটির ভিত নির্মিত। ফলে অনেকগুলো বড় মাপের ভূমিকম্পও এখন পর্যন্ত মসজিদটিতে ফাটল ধরাতে পারেনি। মসজিদটি নির্মাণের পর এখনও বড় ধরনের কোনো সংস্কারের প্রয়োজন পড়েনি। শুধুমাত্র গম্বুজের এক জায়গায় আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে খানিকটা লিকেজ দেখা দিয়েছিল। তখন গম্বুজের ওপরের দিকের কিছু পাথর পরিবর্তন করতে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের তত্বাবধানে বেশ সতর্কতার সঙ্গে সংস্কার কাজ করা হয়, যাতে মূল গঠনে কোনোরূপ পরিবর্তন না ঘটে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনটি এখনও সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টিতে আসেনি ও স্থাপত্য কীর্তিটি এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে সরকারি আনুকূল্য পায়নি।
মসজিদের উত্তর দিক দিয়ে বয়ে গেছে মহাসিং নদ। নদের পাশে দৃষ্টিনন্দন ও ঐতিহাসিক মসজিদটির প্রবেশপথ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন মসজিদটি দেখতে আসেন। মসজিদের সামনে রয়েছে বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। কাঠের তৈরি মসজিদের দরজা ও জানালা। দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠেন মুসল্লিরা। ভেতরে মেঝে ও আশপাশে শৈল্পিক কারুকাজ রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী পাগলা বড় জামে মসজিদটি অযত্নে ও অবহেলায় থাকায় আনুষঙ্গিক কাজগুলো মসজিদের নিজস্ব ফান্ড বা চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়। সরকারের তরফ থেকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ পেলে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি পর্যটন শিল্পে একটা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারতো। তবে অবহেলার ধারাবাহিকতায় দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়তে থাকলে ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না হলে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাগলা বড় জামে মসজিদটি কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে।
যেভাবে যাবেন
সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে সিএনজি বা অটোরিকশায় চড়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পাশে পাগলা বড় জামে মসজিদ পৌঁছাতে পারবেন।