মসজিদের জামাতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ইসলাম

মাসয়ালা, ইসলাম

মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-09-01 19:12:06

দ্বীনি কাজ মানুষ করে থাকে হয়তো আবশ্যক হওয়ার কারণে অথবা সওয়াব লাভের আশায়। মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করা নারীদের জন্য আবশ্যক? নাকি অধিক সওয়াবের? এ প্রশ্নের সমাধানের দিকে তাকালে খুব সহজে ও সুস্পষ্টভাবেই বুঝে আসবে, মসজিদের জামাতে নারীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী কেমন।

হজরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি নারী ও শিশুরা বাড়িগুলোতে না থাকত তাহলে আমি এশার নামাজে দাঁড়িয়ে যেতাম আর যুবকদের বলতাম, (যারা জামাতে শরিক হয়নি তাদের) বাড়িগুলোকে ওরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিত। -আহমাদ: ৮৭৯৬

এ হাদিসে দেখা যাচ্ছে, জামাত ত্যাগকারীদের বাড়িগুলো আগুন দিয়ে না জ্বালানোর কারণ হলো- সেগুলোতে নারীরা আছে। যদি মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করা পুরুষদের মতো নারীদের জন্য আবশ্যক হতো তাহলে নারীরা শাস্তি স্থগিতের উপলক্ষ না হয়ে, শাস্তি প্রয়োগের উপলক্ষ হতো।

তিনি আরও ইরশাদ করেছেন, ওই সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই আমার মনে চায় কাউকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে বলি। অত:পর কাউকে নামাজের আজান দিতে এবং কাউকে জামাতের ইমামতি করতে বলি। অত:পর (জামাতে শরিক হয়নি এমন) পুরুষদের খোঁজে বের করে তাদেরসহ তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেই। -সহিহ বোখারি: ৭২২৪

এ হাদিসে দেখা যাচ্ছে, জামাতে না আসায় হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষুব্ধ হয়েছেন শুধু পুরুষদের ওপর, শাস্তি দিতে চাচ্ছেন শুধু পুরুষদের। যদি মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করাটা পুরুষদের মতো নারীদের জন্যও আবশ্যক হতো তাহলে শুধু পুরুষের ওপর রাগ প্রকাশ না করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ওপরই তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।

বর্ণিত হাদিস দু’টি সুস্পষ্ট ভাষায় প্রমাণ করে যে, মসজিদের জামাত নারীদের জন্য আদৌ আবশ্যক নয়। নারীরা মসজিদের জামাতে শরিক না হলে গোনাহগার হবে না।

এবার আমাদের ভাবতে হবে সম্ভাবনার দ্বিতীয় দিক নিয়ে। মসজিদের জামাতে শরিক হওয়া নারীদের জন্য আবশ্যক না হলেও যদি কোনো নারী কষ্ট শিকার করে আগ্রহী হয়ে মসজিদের জামাতে হাজির হয় তবে কি, সে এতে অতিরিক্ত সওয়াব পাবে?

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বড় ঘরে নামাজ পড়ার চেয়ে ছোট ঘরে নামাজ পড়া নারীর জন্য অধিক ফজিলতের। আবার ছোট ঘরে নামাজ পড়ার চেয়ে ভেতরের ছোট কুঠুরিতে নামাজ পড়া নারীর জন্য বেশি ফজিলতের। -সুনানে আবু দাউদ: ৫৭০

বাড়ির কুঠুরিই নারীর সর্বোত্তম মসজিদ। -আহমাদ: ২৬৫৪২

উম্মে হুমাইদ (রা.) গেলেন নবীর দরবারে। বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার সঙ্গে নামাজ পড়তে ভালোবাসি। নবী করিম (সা.) বললেন, আমিও জানি, তুমি আমার সঙ্গে নামাজ পড়তে ভালোবাসো। কিন্তু তোমার জন্য তো আমার মসজিদের চেয়ে তোমার স্থানীয় মসজিদে নামাজ পড়া বেশি ভালো। আবার তোমার স্থানীয় মসজিদের চেয়ে তোমার বাড়ির আঙ্গিনায় নামাজ পড়া তোমার জন্য বেশি ভালো। আবার তোমার বাড়ির আঙ্গিনার চেয়ে তোমার বড় ঘরে নামাজ পড়া তোমার জন্য বেশি ভালো। আবার তোমার বড় ঘরের চেয়ে তোমার ছোট ঘরে নামাজ পড়া তোমার জন্য বেশি ভালো। অত:পর উম্মে হুমাইদের নির্দেশক্রমে তার ছোট ঘরের সর্বাধিক অন্ধকার কোনায় তার নামাজের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়। আল্লাহতায়ালার সঙ্গে সাক্ষাত (মৃত্যু অবধি) করা পর্যন্ত তিনি সেখানেই নামাজ পড়েছেন। -আহমাদ: ২৭০৯০, ইবনে খুযাইমা: ১৬৮৯

নিজের ঘরের অন্ধকার কোনায় আদায় করা নামাজের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় কোনো নামাজ নারী আদায় করে না। -মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ২১১৫

নারীর জন্য বাইরের চেয়ে আঙ্গিনায় নামাজ পড়া বেশি ভালো, আঙ্গিনার চেয়ে বড় ঘরে নামাজ পড়া বেশি ভালো, বড় ঘরের চেয়ে ছোট ঘরে নামাজ পড়া বেশি ভালো। -মুজামুল আওসাত: ৯১০১

বর্ণিত ৫টি হাদিস প্রমাণ করে, মসজিদের জামাতে শরিক হলে নারীরা বাড়তি কোনো সওয়াব তো পাবেই না। বরং নিজের ঘরে নামাজ পড়ার চেয়ে আরও কম সওয়াব পাবে। তাই অধিক সওয়াব পেতে চাইলে মসজিদে নয় ঘরে নামাজ আদায় করুন।

যেহেতু ইসলাম নারীদের জন্য মসজিদের জামাত আবশ্যক করেনি এবং ঘরে নামাজে আদায়ে বেশি সওয়াব রেখেছে সেহেতু বুঝা যাচ্ছে, মসজিদের জামাতে নারীদের অংশগ্রহণ ইসলামে কাম্য নয়।

এমন একটি হাদিসও পাওয়া যায় না, যাতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের জামাতে উপস্থিত হতে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।

হজরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মসজিদে নববির জামাতে নারীরা শরিক হতো কিন্তু মদিনার অন্য মসজিদগুলোতে জামাতে নারীরা শরিক হতো না। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, মসজিদে নববির জামাতে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি ইসলামের বিস্তৃত সাধারণ কোনো বিধান নয়। এটা নিছক একটি বিশেষ বিধান।

হজরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য লাভের জন্য ও সরাসরি তার থেকে অহির জ্ঞান লাভের জন্য নারীরা মসজিদে নববির জামাতে শরিক হতেন।

বাড়ির কুঠুরিই নারীর সর্বোত্তম মসজিদ

 

মসজিদে হারামে ও মসজিদে নববিতে অদ্যাবধি নিরবিচ্ছিন্নভাবে সব যুগে নারীরা জামাতে শরিক হয়ে থাকে এটাও ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃত ও সাধারণ কোনো বিধি নয়। যেহেতু চব্বিশ ঘণ্টাই তাওয়াফের ও জিয়ারতের অনুমতি আছে আর তওয়াফ ও জিয়ারতের অবস্থায় নামাজের সময় হয়ে গেলে সেখান থেকে বের হয়ে যেয়ে নামাজ আদায় সম্ভব নয় সেহেতু উক্ত দুই মসজিদে সব যুগেই নারীরা জামাতে শরিক হয়ে থাকে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় বলা যায়, জামাতে শরিক হওয়ার জন্য নারীদের মসজিদে যাওয়া ইসলাম পছন্দ করে না। এটা নতুন উদ্ভাবিত কোনো সিদ্ধান্ত নয়। বরং মুসলিম জননী হজরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা, দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.), হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর মতো হাদিস ও ফিকহের শীর্ষস্থানীয় সাহাবাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত এটা।

মুসলিম জননী হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি নারীদের নতুন এ পরিবর্তন দেখতেন তাহলে মসজিদে যেতে তাদের নিষেধ করতেন যেভাবে বনি ইসরাইলের নারীদের নিষেধ করা হয়েছিল। -সহিহ বুখারি: ৮৬৯

এখানে একটা সংশয় জাগতে পারে, মসজিদের জামাতে নারীদের অংশগ্রহণ যদি ইসলামে অপছন্দনীয়ই হতো তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন স্পষ্ট ভাষায় তা ঘোষণা করে যাননি। এর উত্তরে বলতে হবে, শুধু এটা নয়। আরও বেশকিছু বিষয় এমন আছে যা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি স্পষ্ট করে যাননি। পরবর্তী সময়ে সাহাবারা তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যেমন- কোরআনে কারিম একত্রিত করা ও মলাটবদ্ধ করা, মসজিদে তারাবির নামাজের বহু জামাত বন্ধ করে মাত্র এক জামাত চালু রাখা এবং পূর্ণ রমজান মাস তা আদায় করা, খলিফাতুল মুসলিমীন মনোনয়নের শরয়ী পদ্ধতি চালু করা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অধিক সওয়াবের আশায় বা আবশ্যক মনে করে জামাতে শরিক হতে নারীদের মসজিদে গমন ইসলামে অপছন্দনীয়। কিন্তু কোনেরা প্রয়োজনে বাইরে গেলে মসজিদের জামাতে শরিক হওয়া অথবা মসজিদে নামাজ আদায় করা নারীদের জন্য নিষিদ্ধ নয়। তাই রেলস্টেশন, বাস স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল, বিমান বন্দর, বাজার এলাকা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালতপাড়া প্রভৃতি স্থানে অবস্থিত মসজিদগুলোতে নারীদের নামাজ আদায়ের সুব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। হাজারও নামাজি নারী বাইরে গেলে নামাজ কাজা করতে বাধ্য হয় শুধুমাত্র ব্যবস্থা না থাকার দরুণ।

উপরোল্লিখিত মসজিদগুলোতে নারীদের জন্য নামাজ আদায়ের সুব্যবস্থা না করা আবার আবাসিক এলাকার মসজিদগুলোতে স্থানীয় নারীদের নিয়মিত জামাতে শরিক হতে উদ্বুদ্ধ করা উভয়টি ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ির নামান্তর। যা রীতিমতো প্রান্তিকতা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর