উচ্চমূল্যস্ফীতিতে নাভিশ্বাস: সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মানুষ

, অর্থনীতি

নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪..কম |

উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহার মানুষ। কেউ সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন, কেউ সংসার চালাচ্ছেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শেয়ার লোকসানে বিক্রি করে। সব মিলিয়ে কষ্টে আছেন সাধারণ মানুষ। এরকম অবস্থা চলছে গত কয়েক বছর ধরে। সম্প্রতি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, ‘মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিপুল অর্থ। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে আমাদের উন্নতি হচ্ছে। অন্যদিকে বৈষম্য বাড়ছে ভয়াবহভাবে। এতে সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে।’

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে প্রকাশ, সরকার বাজার পরিস্থিতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। শুধু অন্তর্বর্তী সরকারই নয়, কোনো সরকারই তা পারেনি। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, ভোজ্যতেলসহ প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বাজারে পর্যাপ্ত চালের সরবরাহ আছে। তারপরও দাম বাড়ছে।

গত আড়াই বছর ধরে দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতি। এতে জিনিসপত্রের দামের ওপর প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে স্বল্প আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। তবে আশার আলো হচ্ছে, সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমতে শুরু করেছে। জানুয়ারি মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে। বিবিএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং খাদ্যমূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে সরকার চাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের শুল্ক কমিয়েছে। শুল্ক কমালে পণ্যের দাম কমবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনা ঘটছে উল্টো। দাম আরও বেড়েছে। শুল্ক ছাড়ের সুবিধা গেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। এবার রোজার আগে খেজুর, সয়াবিন তেলসহ সব পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি হয়েছে। তার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, শুল্ক-কর কমিয়ে বাজার স্থিতিশীল করা যায়নি। বরং মাঝখান থেকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।’ বাজার নিয়ন্ত্রণে তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি।

সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা রাখেন ব্যাংকে। তারপর নিরাপত্তা ও অধিক মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সুদ বেশি হওয়ার পরও সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছেন মানুষ। এমনকি সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলার প্রবণতা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ২৫ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভেঙেছেন গ্রাহকরা। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সঞ্চয়পত্র কেনার হার ২৭ শতাংশ কমেছে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া ও ভাঙানোর হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বেড়েছে। সেই হারে আয় বাড়ছে না। সে জন্য অনেকেই সঞ্চয়পত্র ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার ব্যাংকের আমানতের সুদ বা মুনাফা আকর্ষণীয় নয়। বর্তমানে আমানতের সুদ মূল্যস্ফীতিরে চেয়ে কম। আবার অনেক ব্যাংক গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না। এসব কারণেও সঞ্চয়পত্র ভাঙাচ্ছেন অনেক গ্রাহক।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, ‘মানুষের যখন আয়ের চেয়ে ব্যয় কম হয়, তখন সঞ্চয় করেন। এখন অনেকেরই আয় নেই। কিন্তু ব্যয় বেড়েছে। ফলে তারা সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করেন মধ্যবিত্তরা। বিগত কয়েক বছর উচ্চমূল্য স্ফীতির কারণে মধ্যবিত্তদের ওপর চাপ বেড়েছে। কাজেই সঞ্চয়পত্রে দীর্ঘসময় ধরে বিনিয়োগ করতে হয়। দীর্ঘসময় বিনিয়োগ করার জন্য যে ধরনের আর্থিক সংগতি দরকার, মধ্যবিত্তের এখন সেটা নেই। কাজেই নতুন করে তাদের সঞ্চয়পত্র কেনার সক্ষমতা নেই।’

আমদের কী সুদিন আসবে না, এই দুঃসময় কত দিন থাকবে? –এ প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এটা নির্ভর করছে আমাদের বর্তমান আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। এখন আমরা একটা ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে আছি। অর্থনীতির বিধ্বস্ত অবস্থা কেটে যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সব কিছু একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। বিনিয়োগ করার জন্য যা দরকার সেই পরিবেশ নেই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী কেউই এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। এ অবস্থায় দেশে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে? কর্মসংস্থান না বাড়ালে আয় বাড়বে না। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার মতো অবস্থা নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবে যাদের আগে সঞ্চয়পত্র ছিল, তারা ভাঙিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার নির্বাহ করছেন।’

বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে ব্যাপক। নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত আমানত রয়েছে। যে কারণে আমানতের সুদহার কম। আগে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আকর্ষণীয় হারে মুনাফা দিত। যে কারণে গ্রাহকরা ব্যাংকে বেশি টাকা রাখত এবং মুনাফা দিয়ে সংসার চালাত। এখন আমানতের সুদহার কম থাকায় গ্রাহকরা ব্যাংকমুখী হন না। আবার শেয়ারবাজারের মন্দাভাবের কারণে অনেকে বড় ধরনের পুঁজি হারিয়েছেন। বিশেষ করে যারা ঋণ করে বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আয় না থাকলে সঞ্চয় ভাঙানো বাড়বে। আয় বৃদ্ধির তুলনায় ব্যয় বেশি হলে সঞ্চয়ের ওপর হাত পড়বে। গত কয়েক বছর ধরে অর্থনীতি যে দুর্বল একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছে, বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রকৃত মজুরি ধারাবাহিকভাবে নিম্নগামী, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা- এসব জায়গা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না।’

২০১৬ সালের পর থেকে শ্রমবাজারে এ ধরনের একটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের পথ কী? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উত্তরণের কথা বলতে গেলে আগের কথাই বলতে হয়। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ জন্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। ব্যাংক খাতের দুরবস্থা কাটাতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার জোগান যথাযথভাবে নিশ্চিত করা। পাশাপাশি ব্যবসা চালু করতে গেলে যেসব নিয়ম-কানুনের জটিলতা আছে, সেগুলো নিরসন করতে হবে।’

মানুষের সামনে যে দুঃসময় তা কি শিগগিরই কাটবে না? সুদিন কী আসবে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আসবে না বললে ঠিক হবে না। কারণ ইতিহাস বলে আমরা চাইলে পারি। কী করতে হবে, কেন করতে হবে সেটা পুনরায় আবিষ্কারের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন কথাটা হচ্ছে করার সদিচ্ছা আছে কি না এবং কীভাবে করব- সেটা নির্ধারণ করতে হবে। সেটা হবে কি না বা কবে হবে তার জন্য অপেক্ষা আর প্রার্থনা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর