সাধারণ ধারণা অনুযায়ী দেবী সরস্বতী হিন্দু ধর্মের মা দূর্গার এক কন্যা। যিনি অবিবাহিত এবং বিদ্যার দেবী। কিন্তু এর প্রচুর ভাগ আছে বিভিন্ন পৌরাণিক মত অনুযায়ী। তবে এই যে ডিজিটাল যুগের পুজো তাতে কিন্তু মা সরস্বতীর প্রভাব কমে নি। আধুনিক হয়েছেন তিনি মানুষের কল্পনায়, ভাবনায় তার আধুনিক রূপ দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়াতে। যেমন মা সরস্বতী আসছেন হঠাৎ ট্যাক্সিওয়ালা তাঁকে বলছেন হাঁসের জন্য ভাড়া বেশি। আবার দেবী বলছেন খুব মজা সব বই রেখে দিয়েছ, যাও অঙ্ক বই নিয়ে যাও। এইসব –এর মাঝে অন্য কথাও আছে; যেমন কেউ বলছেন লক্ষী মেয়ে হতে গিয়ে কত কত সরস্বতী হারিয়ে যাচ্ছে। আসলে পুজো তো একটা প্রতীকও বটে। ক্রমাগত অসহিষ্ণু আমি আমি প্রবণ পরিস্থিতিতে এই পুজো হয়ত মেলবন্ধনের একটা উপায়। যে শাড়ির গা থেকে সুতো কমনীয়তা জড়িয়ে রাখে ভালবাসার আদুর গা সেই হলদে শাড়ি এখনো ভেসে ভেসে ওঠে এই বসন্তপঞ্চমীর দিনে। যে প্রেম এখন ভিডিও কলের গায়ে এসে ভেসে ওঠে ভার্চুয়াল ভঙ্গিমায় , এই দিনে সেই প্রেমও প্রাকৃতিক হতে চায়। আসলে ধর্ম, মূর্তিপুজোর চেয়েও বড় কথা একটা প্রভাব মানুষের জীবন কতখানি ইতিবাচক করে তোলে। বই তুলে রেখে একটা দিন মুক্ত হয়ে ভরে থাকে ছোট ছোট কচিকাচারা এই কী কম কথা। কারণ মানুষের আনন্দ এখন খুব ক্ষণস্থায়ী, ক্ষয়িষ্ণু কারণ প্রলোভন অনেক বেশি।
বসন্ত পঞ্চমীতে কিন্তু খাওয়ার দারুণ সব মেনু আছে বিভিন্ন জায়গায়; শীতল ষষ্ঠী এরকমই এক প্রকার। সাধারণত আমরা ভাবি বাংলায় এবং কেবল হিন্দুদের মধ্যেই এই দেবীর পুজো হয় কিন্তু পশ্চিম ও মধ্য ভারতে জৈনরা ও বৌদ্ধরাও এই পুজো করেন এমনকি জাপান, মায়ানমার, ভিয়েতনামেও এই পুজো হয়। এই পুজো অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দের আমলে আড়ো বৃহত্তর হয়ে ওঠে। তার সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলে প্রথম সরস্বতী বন্দনার ত্রিপদী লেখেন। প্রাচীনকালে অবশ্য সরস্বতী নামে এই পুজো হত না। তান্ত্রিক সাধকরা বাগেশ্বরী নামেই এই পুজো করতেন বলে জানা যায়।ঊনবিংশ শতাব্দী অবধি মেয়েরা এই পুজোয় অঞ্জলি দিতে পারত না। অনেক পরে তারা এই অধিকার অর্জন করে। সরস্বতী শব্দের অর্থ নিয়েও ভিন্ন মত আছে। কেউ বলেন এটি নদী , কেউ বলেন এটি সূর্যাগ্নি। আবার ভিন্নার্থে এর মানে জ্যোতির্ময়ী। উত্তর ও দক্ষিণভারতে দেবী ময়ূরএর বাহনে পূজিত হন অন্যত্র যেমন হাঁস। পুরাণের মত অনুযায়ী তিনি যোগ , সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি ,মেধা এরূপ প্রায় আটশক্তির অধিকারিণী। বলা হয় অং থেকে ক্ষং মধ্যস্থ পঞ্চাশটি বর্ণে তার দেহ সুশোভিত। এই আলোকিত দেবী কখনো নারায়নের পত্নী, কখনো ব্রহ্মার সন্তান, কখনো দূর্গার কন্যা, কখনো আতিথেয়তার নারী, কখনো পুণ্যের নদী হয়ে এসে মর্ত্যে বিচরণ করেছেন । এমন কথাও আছে সরস্বতী দেবী মানুষের স্পর্শ সহ্য করতে পারতেন না তাই তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে সর্প পরিমন্ডলে বেষ্ঠিত হয়ে দ্বীপে উপবিষ্ট হয়েছিলেন।
আসলে রূপকথা যতই কল্পনার হোক তাতে মানুষের দর্শন এসেই যায় কারণ তা মানুষের রচনা তাই স্বভাবতই কল্পচিত্রেও ভেসে ওঠে। দেবীর আরাধনা আসলে ব্যক্তির নিজ মধ্যস্থ ভাল চিন্তারই আরাধনা। দেবীর সাধনা আমাদের শিল্প, সাহিত্যকে স্বীকৃতি দিক এটুকুও চাওয়া পাওয়া।