স্বাদকে মাথায় রেখে খাদ্যের রূপ দিতে ব্যস্ত ভারতীয়, শুধু ভারতীয় কেন এই গোটা বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের জুড়ি মেলা ভার। সস্তায় সুস্বাদু খাদ্য খেতে খাওয়াতে এমনিতেই বাঙালি ব্যতিক্রমী। মনের কাছাকাছি টকজলে ভরা মুচমুচে আলুসঙ্গ করা ময়দা-সুজির ফুলকো ফুলকো রূপের নাম ফুচকা। যা আমাদের শব্দ সহযোগে বীরবিক্রমে মুখের ভেতরে রেখে খাওয়ার আনন্দ দেয়। হালকা ফুরফুরে অথচ স্বাদে চোখের জলে, মুখের জলে করে দিতে পারা ক্ষমতাসম্পন্ন ফুচকাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। এর পেটে বিভিন্ন রহস্য ভর্তি থাকে অঞ্চলভেদে। কত তার বাহারি নাম।বিদেশিরাও এসে সার্ভে করে বলে গেছে “এর মতো স্ট্রিটফুড নাকি হয় না।’’
সে তারা বলুক বা নাই বলুক। কচি থেকে বুড়ো কে না ফুচকার দিকে লাজুক লাজুক চোখে তাকায়। উঁচু উঁচু বাবা-মার পাশে ছোট্ট খোকা হাত বাড়িয়ে, লোভাতুর দৃষ্টি দিয়ে রাখে বাবা-মার শালপাতার মহার্ঘ্য ফুচকার দিকে। দয়ালু বাবা-মা শেষকালে একটা শুকনো পাপড়ি (শুকনো ছোট ফুচকা) তার হাতে তুলে দেয় আর সে জিতে যায়। বাড়ির বৃদ্ধ জানলা দিয়ে দেখে একতলায় নাতনি ফুচকাওলাকে ডেকে গোগ্রাসে খেয়েই যাচ্ছে, লাস্টে বলছে কাকু টক জল কিম্বা আরো একটা ফাও। ওপরে দাদু বা দিদা কিম্বা ঠাম্মার বারণ সত্ত্বেও জুলজুল চোখকে স্বীকৃতি দেবে ক্ষুধে নাতি বা নাতনি। হয়ত শালপাতায় লুকিয়ে নিয়ে আসবে ফুচকার বিস্রস্ত রূপের চুরমুর!তাহলে ফুচকার জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো কথা হবে না। এই যে চাট বা চুরমুর যা তৈরি হয় অবশিষ্ট না ফোলা ফুচকা দিয়ে আলু , মটর, মশলা সহযোগে। এর উৎপত্তি অবশ্য যেমন তেমন জায়গায় নয়। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজকীয় রান্নাঘরে এর আগমন; সম্রাট যখন অসুস্থ কিছুই তার মুখে রোচেনা তখন শাহী হাকিম নির্দেশ দিলেন এই পদের; যা ঝাল ও মশলায় পূর্ণ থাকবে কিন্তু পাকস্থলীর পক্ষে কোনো ভারী খাবারও নয় যাতে সম্রাটের অনাক্রমতা উজ্জীবিত হবে । সেই আসল ফুচকার চাট। ফুচকার আসল আগমন নিয়ে কিছু কথা রটনা হিসেবে আছে যেমন বলা হয় ফুচকার অন্য সংস্করণ পানিপুরির উদ্ভব দক্ষিণ মগধে, এর নাম তখন ছিল ফুলকি, তারপর অবশ্য বারাণসিকেও এর উদ্ভবের স্থান বলে মনে হয়েছে।
বাংলাদেশে ফুচকা জনপ্রিয় হয় প্রায় ১৯৫০ সাল পরবর্তী সময়। আরো কথিত আছে, গঙ্গা নদীর তীরে মগধ রাজ্যে ফুচকা প্রথম আসে। তারপরে মুগলদের রাজত্বে তার পূর্ণ রূপ প্রকাশিত হয় ফুচকা রূপে। আবার মহাভারত থেকেও এর আগমন বলে ধরা হয়।শোনা যায় সদ্য বিবাহিত নববধূ দ্রৌপদী যখন কুন্তীর কাছে আসেন তখন নিয়মের সাযুজ্যে কুন্তী তাঁকে নতুন কিছু করে খাওয়াতে বলেন। কিন্তু তখন পান্ডব বংশে দারিদ্র্যের ছায়া ফলে অতি সামান্য সুজি, ময়দা ,আলু এইসব তিনি দ্রৌপদীর হাতে তুলে দেন। তা দিয়ে নাকি দ্রৌপদী প্রথম ফুচকা বানিয়েছিলেন এবং তা খেয়ে কুন্তী আশীর্বাদ করে বলেছিলেন এই খাদ্য সকলের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। বিদেশীরা একে কিং অফ স্ন্যাক্স বলেছেন কারণ এর উপাদান সহজেই জিভের সমস্ত স্বাদকোরকে পৌঁছে যায় এবং তা মেজাজ পরিবর্তনে সাহায্য করে ।সাধারণ আকারের ছয়টি ফুচকায় মোট ৪৭৫ ক্যালোরি উপস্থিত থাকে।
ভিন্ন স্থানে ভিন্ন নামে ফুচকার জনপ্রিয়তা; মোটের ওপর এক হলেও তারতম্য স্বাদে কিছু আছে।যেমন গুজরাটে এর নাম পকোড়ি , এইক্ষেত্রে ফুচকায় ঝুরি ভাজা থাকবেই সঙ্গে পুদিনা ফ্লেভারের টক জল।হায়দ্রাবাদে এর নাম টিক্কি, টিক্কির সঙ্গে কলকাতার ফুচকার মোটামুটি সাদৃশ্য আছে। রাজস্থানে এর নাম পাতাশি । লখনৌতে আবার এই পাতাশি বা বাতাশিকে একের বেশী প্রায় পাঁচটি ভিন্ন স্বাদের জলে মেশানো হয়। একে বলে “পাঁচ সোয়াদ কে বাতাশে।’’ এখানে ফুচকার স্পেশাল ব্যাপার হল টক জলে শুকনো আমের ব্যবহার। উড়িষ্য্য এর নাম গুপ চুপ; মধ্যপ্রেদেশের সেভপুরি নামক ফুচকার পদ্ধতি অবশ্য বেশ চমকপ্রদ । দিল্লীর দহি পুরির জনপ্রিয়তা এখন এমন জায়গায় যে সব ফুচকার জায়গায় প্রায় বিশেষত এর নাম লেখা থাকে। ফুচকায় দই এর মিষ্টি চাটনির সহযোগ এর বিশেষ নিদর্শন।এছাড়াও মহারাষ্ট্রের পানিপুরি,উত্তরপ্রদেশের ফুলকি, হরিয়ানার গোলগাপ্পা এইসব যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তা বলা বাহুল্য।
কলকাতার ফুচকা যে কতখানি জনপ্রিয় তা বুঝতে গেলে দুপাশে ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। স্কুল, কলেজ, অফিস, মার্কেট সবার সীমানায় ফুচকার গাড়ি প্রস্তুত থাকে। কলকাতার বহু জায়গার ফুচকা স্বাদের বিভিন্নতায় বিখ্যাত। যেমন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে যে ফুচকার গাড়ি থাকে তাদের স্পেশাল চাটনি যাকে বলে দারুণ। এছাড়া বিবেকানন্দ পার্ক, চক্রবেড়িয়া ট্রাইঙ্গুলার পার্ক, রাসেল স্ট্রিটের মোড় –এখানকার ফুচকার জবাব নেই । আরো যে কত নিত্যনতুন ফুচকার পদ আবিষ্কার হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। চকলেট ফুচকা, চিজ ফুচকা ইত্যদি ইত্যাদি। জানি জিভে জলে আসছে, ঢোক গিলে নিচ্ছেন, তা নিন। কিন্তু এ খাবার নিয়ে দুঃখের কিছু নেই সস্তা এবং সর্বত্র পাওয়া যায় ফলে আজ না হোক কাল তো ফুচকা বিরহ মিটবেই। ফুচকা প্রেম বড়ই শক্তিশালী; সেও মানুষের জিভ ভালবাসে মানুষের জিভও তাঁকে, ফলে রাজযোটক।