চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অমলিন স্বাদ ‘বেলা বিস্কুট’

  • সীরাত মঞ্জুর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

চট্টগ্রাম কলেজের সড়ক ধরে চকবাজার থেকে সামনের দিকে এগোলে তিন রাস্তার মোড়ের কাছে এসে চোখে পড়বে একটি পুরনো অথচ পরিচিত স্থাপনা চট্টগ্রামের গণি বেকারি। এতেই মনে পড়বে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুটের কথা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক অমলিন অংশ হয়ে আছে। চন্দনপুরার সরু গলিপথ, পুরনো দিনের বাড়ি আর বাতাসে মিষ্টি ঘ্রাণ; সবই যেন বেলা বিস্কুটের গল্প বলে।

বিজ্ঞাপন

বেলা বিস্কুট শুধু একটি খাবার নয়, এটি চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, আবেগ এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। চট্টগ্রামের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে এতটা গভীরভাবে জড়িয়ে আছে, একে ছাড়া শহরের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। এটি শুধু মিষ্টি ও মসলাদার স্বাদের জন্যই নয়, বরং চট্টগ্রামের মানুষের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের এক অমূল্য অংশ।

চট্টগ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী খাবার বেলা বিস্কুট

ঐতিহ্যের যাত্রা: বেলা বিস্কুটের শুরুর গল্প
বেলা বিস্কুটের উৎপত্তি চট্টগ্রামের চন্দনপুরা অঞ্চল থেকে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এর উদ্ভাবক ছিলেন বেলায়েত আলী নামক এক রন্ধনশিল্পী, যিনি মিষ্টি, মসলাদার বিস্কুট তৈরি করার বিশেষ কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। তবে কিছু ইতিহাসবিদ বলেন, ব্যবসায়ী আব্দুল গণি সওদাগর ছিলেন বেলা বিস্কুটের প্রবর্তক। তিনি নিজের পানসি নৌকায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রামে বিস্কুট ছড়িয়ে দিয়ে এটি জনপ্রিয় করেছিলেন। গণি সওদাগরের হাত ধরেই বেলা বিস্কুট আজ চট্টগ্রামের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে।

বিজ্ঞাপন
ব্যবসায়ী আব্দুল গণি সওদাগর ছিলেন বেলা বিস্কুটের প্রবর্তক

কোনভাবেই হোক, বেলা বিস্কুটের ইতিহাস চট্টগ্রামের প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এটি শুধু একটি খাবার নয়, এটি চট্টগ্রামের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। চট্টগ্রামের লোকজনের কথা, তাদের আবেগ, স্মৃতি এবং ঐতিহ্য সব কিছুই যেন এক টুকরো বিস্কুটের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে।

চট্টগ্রামের প্রতিদিনের সঙ্গী বেলা বিস্কুট
চট্টগ্রামের আড্ডা, নাশতা কিংবা অতিথি আপ্যায়নে বেলা বিস্কুটের উপস্থিতি অপরিহার্য। এক সময়, বাড়ির উঠানে চায়ের সঙ্গে এই বিস্কুট না থাকলে মনে করা হতো, অতিথি আপ্যায়ন পূর্ণ হয়নি। এই বিস্কুটটি চট্টগ্রামের আড্ডার অংশ হয়ে উঠেছে, যেখানেই হোক, চা-সঙ্গে থাকা উচিত বেলা বিস্কুট। বিশেষ করে প্রেস ক্লাবের আড্ডা থেকে শুরু করে স্কুলের টিফিন, দোকানের চায়ের কাপ-সবখানেই বেলা বিস্কুট ছিল এবং আজও আছে। স্থানীয়রা প্রায়ই বলে থাকেন, বেলা বিস্কুট ছাড়া চট্টগ্রামের আড্ডা জমে না!

এটি চট্টগ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী খাবার। স্থানীয় বাসিন্দারা বেলা বিস্কুটের স্বাদে এমন এক মিষ্টি মোলায়েমতা খুঁজে পায়, যা তাদের প্রাচীন স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এক টুকরো বেলা বিস্কুট যেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতির অমূল্য এক অংশ, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঐতিহ্যকে জীবিত রেখেছে।

বিস্কুট তৈরির রহস্য 
বেলা বিস্কুটের মিষ্টি এবং মসলাদার স্বাদ তার বিশেষ রেসিপি ও প্রস্তুত প্রণালী থেকে আসে। এই বিস্কুটের উপাদানগুলো যদিও বেশ সাধারণ, তবুও প্রস্তুত প্রণালী খুবই বিশেষ। মূল উপকরণগুলো হলো: গমের ময়দা, চিনি বা গুড়, ঘি বা তেল, বেকিং সোডা, বিশেষ মসলা (যা সাধারণত গোপন রাখা হয়)।

এদের সঠিক মিশ্রণ আর প্রস্তুত প্রণালীই বেলা বিস্কুটের গুণমান নির্ধারণ করে। ময়দা, চিনি, ঘি এবং মসলাকে একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয় মণ্ড। এরপর এই মণ্ডটিকে বিশ্রামে রেখে তন্দুরে বা মাটির চুলায় বেক করা হয়। তন্দুরের তাপমাত্রায় বাইরের অংশ শক্ত হয়ে যায়, কিন্তু ভেতরটা থাকে তুলতুলে, যা বেলা বিস্কুটকে একদম আলাদা করে তোলে।

গণি বেকারির ভূমিকা
চট্টগ্রামের গণি বেকারি বেলা বিস্কুটের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বেকারিটি প্রথম বেলা বিস্কুট তৈরি করে এবং সেটি ছিল চট্টগ্রামের প্রথম বেলা বিস্কুট। প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল গণি সওদাগরের হাত ধরে এই বেকারির যাত্রা শুরু হয়, এবং আজও এটি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে বেলা বিস্কুট তৈরি করছে। যা বর্তমানে বংশপরম্পরায় চতুর্থ প্রজম্নের হাতে রয়েছে।

Caption

বর্তমান স্বত্তাধিকারী আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম বলেন, আমার বড় দাদা আব্দুল গণি সওদাগরের বেকারিটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পূর্বপুরুষের ধারাবাহিকতায় এটি চালু করেন। ১৮৭০ সালের দিকে গণি বেকারি থেকে বেলা বিস্কুটের যাত্রা শুরু হয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দাদা দানু মিয়া সওদাগর, বাবা জামাল উদ্দিন খান সাহেবের হাত ধরে এটি এগিয়েছে। বর্তমানে আমি এই ঐতিহ্য বহন করছি। এই বিস্কুট চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি।

কাদামাটির তন্দুরে বেলা বিস্কুটের প্রস্তুতি
গণি বেকারির পেছনেই রয়েছে বিস্কুট তৈরির এক পুরোনো কারখানা, যেখানে এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতে বেলা বিস্কুট তৈরি করা হয়। পুরনো কাদামাটির তন্দুরে বিস্কুট সেঁকা হয়, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির বদলে প্রাচীন সময়ের মতই খামি সাজিয়ে তন্দুরের ভেতর রাখা হয়। এই পদ্ধতিতে বিস্কুট তৈরি করতে প্রায় দুই দিন সময় লাগে। প্রথমে ময়দা, চিনি, লবণ, ভোজ্যতেল, ডালডা, গুঁড়া দুধ ও বিশেষ একধরনের মসলা দিয়ে খামি তৈরি করা হয়। পানির সঙ্গে মিশিয়ে প্রস্তুত করা এই খামিতে ইস্টের বদলে বিশেষ মাওয়া ব্যবহৃত হয়, যা বিস্কুটের স্বাদে এনে দেয় এক অনন্য বৈচিত্র্য।

 প্রস্তুত প্রণালীই বেলা বিস্কুটের গুণমান নির্ধারণ করে

এই খামি মিশিয়ে একদিন রেখে দেওয়া হয়, এবং পরবর্তীতে তন্দুরে প্রথম দফায় সেঁকা হয় ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় ধরে। এরপর, দ্বিতীয় দফায় আরও সেঁকে তৈরি করা হয় বেলা বিস্কুট। প্রথমে কাঠ ব্যবহার হলেও এখন গ্যাস এবং কয়লা দুইই ব্যবহৃত হয়।

বিক্রি ও জনপ্রিয়তা: গণি বেকারির বেলা বিস্কুটের আধিপত্য
গণি বেকারির বেলা বিস্কুটের চাহিদা কখনোই কমেনি। প্রতিদিন এখানকার বিভিন্ন বয়সী ক্রেতা তাদের পছন্দের বেলা বিস্কুট নিতে আসে। এখানে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ প্যাকেট বা ৬ থেকে ৮ হাজার পিছ বেলা বিস্কুট প্রস্তুত করা হয়। গণি বেকারির বেলা বিস্কুটের মধ্যে দুটি প্রধান ধরনের পাওয়া যায়—মাখন বেলা এবং রোজ বেলা। মাখন বেলার দাম কিছুটা বেশি, ৩০ পিসের দাম ১৫০ টাকা, এবং ৪৫০ গ্রামের সাধারণ রোজ বেলার দাম ১১০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

দেশ গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে বেলা বিস্কুটের বিস্তার
একসময় বেলা বিস্কুট শুধুমাত্র চট্টগ্রামের ছোট ছোট দোকানে পাওয়া যেত। কিন্তু এখন এটি চট্টগ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পৌঁছে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বেলা বিস্কুট কিনে নস্টালজিয়ায় ডুবে যান। এটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করেছে।

কেন এত জনপ্রিয়?
বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ তার স্বাদ এবং আকার। এই বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে খাওয়ার জন্য একদম আদর্শ। তার বড় আকৃতি, শক্ত বাইরের আবরণ এবং নরম ভেতরের মিশ্রণই একে অন্য সব বিস্কুট থেকে আলাদা করেছে। এর মিষ্টি-মসলাদার স্বাদ পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। স্থানীয় দোকান থেকে শুরু করে বড় সুপারশপেও এটি সমান চাহিদা নিয়ে বিক্রি হয়।

বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে খাওয়ার জন্য একদম আদর্শ

আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ

বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে এখন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। দ্রুত উৎপাদনের চাপে অনেকেই রেসিপি পরিবর্তন করছেন, যার ফলে এর স্বাদ এবং গুণমানে প্রভাব পড়ছে। তবে গণি বেকারির মতো কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে বেলা বিস্কুট তৈরি করে এর মূল গুণ বজায় রাখছে।

ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব
বেলা বিস্কুট শুধু একটি খাবার নয়; এটি চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মানুষের আত্মপরিচয়ের এক অংশ। এটি আমাদের অতীতের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয় এবং বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটি পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। গণি বেকারির উত্তরসূরি আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম বলেন, বেলা বিস্কুটের ইতিহাস শুধু ব্যবসার নয়, এটি আমাদের গর্ব, আমাদের ঐতিহ্য।

চট্টগ্রামের সোনালি অধ্যায়
বেলা বিস্কুট আজও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের একটি অমূল্য রতœ হয়ে আছে। এটি শুধু একটি খাবার নয়, এটি চট্টগ্রামের মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সোনালি অধ্যায়ের মতো রেখে যাবে।

চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুট শুধু একটি খাদ্য নয়, এটি এই শহরের গর্ব এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। এর ইতিহাস, স্বাদ, এবং নির্মাণ প্রক্রিয়া সবকিছুই এটিকে একটি বিশেষ খাবারে পরিণত করেছে। আজকের প্রজন্মের উচিত এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া।