অবৈধ বিদেশি সিগারেটে সয়লাব সিলেট, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
-
-
|

অবৈধ বিদেশি সিগারেটে সয়লাব সিলেট, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও সিলেট বিভাগজুড়েই থামছে না চোরাচালান। বিভিন্ন ধরণের চোরাচালান পণ্যের সঙ্গে দেশে আসছে বিদেশি ব্রান্ডের সিগারেট। সম্প্রতি তিন স্তরের সিগারেটের ওপরে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ফলে তামাকজাত পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে সিগারেট নিয়ে আসছে। পরে সেগুলো বাজারে প্রশাসনের নাগের ডগায় প্রকাশ্যে বিক্রি হলেও নীরব ভূমিকা পালন করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সচেতন মহল বলছেন- আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সক্রিয় নজরদারি ও তৎপরতা না থাকার কারণে সহজে কেনা বেচা হচ্ছে খুচরা ও পাইকারি দোকানগুলোতে। সম্প্রতি সরকার অনেক পণ্যের সঙ্গে সিগারেটের ওপর ভ্যাট ট্যাক্স বাড়ানোর ফলে সিগারেটের দামও বেড়েছে। যার কারণে কম দামি এসব অবৈধ সিগারেটের বাজারও বেড়ে গেছে। এতে করে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন-অবৈধ পথে আসা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্রান্ডের সিগারেট বিক্রেতার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এনবিআরে এর আদেশ
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্থাটির দ্বিতীয় সচিব প্রণয় চাকমার সই করা আদেশ সূত্রে জানা যায়, এবার অবৈধ ও রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া সিগারেট নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি করা হচ্ছে।
এনআরবির জারিকৃত আদেশে কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়- সিগারেট, বিড়ি ও তামাক জাতীয় পণ্য থেকে আহরিত ভ্যাটের প্রায় ২৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়। অবৈধ তামাক জাতীয় পণ্যের কারণে দেশের সামগ্রিক রাজস্ব আদায় মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এরপরেই সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ সিগারেট, বিড়ি ও তামাক জাতীয় পণ্যের বিরুদ্ধে এনবিআর এর সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হয়।
অভিযান
এনবিআর জানায়, এ বছর জানুয়ারি মাসে অভিযান হয় ৫২ টি। এতে ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা (পশ্চিম) ২৪ টি, রাজশাহী ১৭ টি, ঢাকা (পূর্ব) ৪ টি, কুমিল্লা ২ টি, রংপুর ১ টি অভিযান পরিচালনা করে। অন্যদিকে ১ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ১০ দিনে অভিযান হয়েছে ১০৭ টি। অভিযানের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত মোট অভিযান হয় ৩০ টি। ১০ ফেব্রুয়ারি অভিযান হয় ২৩ টি। ১১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে সবগুলো কমিশনারেট মোট ৫৪ টি অভিযান পরিচালনা করে। এরমধ্যে ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা (দক্ষিণ) ৪ টি, ঢাকা (উত্তর) ১ টি, ঢাকা (পশ্চিম) ১০ টি, চট্টগ্রাম ১২ টি, রাজশাহী ১২ টি এবং কুমিল্লা ৩ টি অভিযান পরিচালনা করে।
আরও জানা যায়, ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার সীমান্ত এলাকাগুলোতে কিছুদিন চোরাচালান বন্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকাগুলো দিয়ে প্রতিদিন আসছে চোরাইপণ্য আর এসব পণ্যের আড়ালে আসছে বিদেশী ব্রান্ডের সিগারেট। তুলনামূলক কম হওয়ার ফলে ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
আর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বর্ডারগাড বাংলাদেশ (বিজিবি) টহল বৃদ্ধি ও চোরাচালান প্রতিরোধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি।
বিক্রি করছেন বিনা বাধায় অবৈধ বিদেশী সিগারেট
সরেজমিনে সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বিক্রেতারা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে সহজে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানীর সিগারেট ক্রয় করে তাদের দোকানগুলোতে এনে বিক্রি করছেন বিনা বাধায়। আর পাইকারি দোকানগুলোতে বিভিন্ন পণ্যের পসারের সঙ্গে দুই-চারটি বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট রেখে দেন। সিলেট নগরীর লালদীঘিরপাড়, হকার্স মার্কেট ও বন্দরবাজারে ওপেন সিক্রেট বিক্রি হতে দেখা যায় ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানীর সিগারেট। এছাড়া জেলার বিভিন্ন বাজার ও পাড়া-মহল্লার ছোট দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে অবৈধ বিদেশি সিগারেট।
১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার মৌলভীবাজারে যৌথ অভিযানে ৩২ হাজার শলাকা দেশীয় উৎপাদিত অবৈধ সিগারেট জব্দ করা হয়েছে।
ওরিস, মন্ডসহ অবৈধ বিদেশি সিগারেটে সয়লাব সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার
সূত্র বলছে- সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের পাইকারি দোকানগুলোতে দুই-চারটি প্যাকেট সাজিয়ে রাখেন বিক্রেতারা। অভিযান বা কোনো কিছুর খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সরিয়ে রাখেন। তবে তাদের নির্দিষ্ট ক্রেতা হলে চাহিদা অনুযায়ী তাদের গোডাউন থেকে সরাসরি বা ফোনের মাধ্যমে জানালে নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসব সিগারেট পাঠিয়ে দেন। এছাড়া সিলেট নগরীর কালীঘাট, হকার্স মার্কেট ও লালদীঘিরপাড় এলাকায় বিদেশি সিগারেটের ভাসমান দোকান নিয়েও বসতে দেখা যায়। যদিও সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে বাংলায় সতর্কীকরণ লেখা ও ছবি ছাড়া সকল সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ। এছাড়া বাধ্যবাধকতা রয়েছে রাজস্ব স্ট্যাম্প থাকারও। কিন্তু চোরাচালানের মাধ্যমে নিয়ে আসা এসব সিগারেটের ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো বালাই নেই।
সূত্র আর বলেছে-সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও কানাইঘাট, সুনামগঞ্জ সদরের বাংলাবাজার, বিশ্বম্ভরপুরের ধনপুর, চিকারকান্দি, মথুরকান্দি ও দোয়ারাবাজারের বোগলা ও লক্ষ্মীপুর মধ্যবর্তী ভাঙ্গাপাড়া ও বাঁশতলা। এছাড়া মৌলভীবাজারের কিছু সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে আসে চোরাচালান। ওই চোরাচালানের সঙ্গে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে বিভাগজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসা সিগারেট।
রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসা চোরাই সিগারেটগুলোর মধ্যে রয়েছে-ডানহিল, মার্লবোরো, ব্ল্যাক, জাভা ব্ল্যাক, স্ট্রবেরি, ওরিস, মন্ড ইত্যাদি।
খুচরা সিগারেট বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা খুব সহজেই এসব বিদেশি সিগারেট সংগ্রহ করতে পারেন। ফোন করলে সাইকেলে করে বিক্রয় কর্মীরা এসে সিগারেট দিয়ে যায়। আবার কখনো কখনো দোকান গিয়ে নিজেরা আনতে হয়।
যখন সীমান্ত এলাকা দিয়ে সিগারেট আসা বন্ধ হয়ে যায় তখন পাইকারি বিক্রেতারা দাম বেশি রাখেন। না হয় ১৩০-১৫০ টাকায় স্ট্রবেরি ও ওরিস সিগারেট ক্রয় করতে পারেন । বিদেশি সিগারেট বিক্রি করলে তাদের লাভ অনেক বেশি থাকে তাই বিক্রি করেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
এব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (মেট্রো) দেবানন্দ সিনহা বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। সিলেটের পাশাপাশি সুনামগঞ্জের দায়িত্ব থাকার ফলে সেখানেও অভিযান চালিয়ে সিগারেট জব্দ করেছি এবং জরিমানা আদায় করা হয়েছে। আমরা বিভিন্নভাবে তথ্য নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছি।
জানতে চাইলে সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮বিজিবির) এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হক বলেন, সীমান্তে নিরাপত্তা রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধকল্পে বিজিবির আভিযানিক কার্যক্রম ও গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাইপণ্যের মধ্যে চিনি ও লিকুইড জাতীয় মাদক আসে। ইতোপূর্বে আমরা অনেকগুলো চালান ধরেছি। কিন্তু তামাকজাত পণ্যের কোনো ওই রকম বড় কোনো চালান আমরা পাইনি।
এব্যাপারে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সমর কুমার পাল বলেন, চোরাচালন প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তৎপর রয়েছে। অবৈধ পথে যেসব সিগারেট বাজারে প্রবেশ করে সেগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা অবৈধ সিগারেটের কোনো কিছু পাইনি। অবৈধ সিগারেট বিক্রির তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ।
সিলেট ব্যাটালিয়ন (১৯বিজিবির) এর অধিনায়ক ও মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ইসরাইল হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া না পাওয়া বক্তব্য নেয়া যায়নি।