বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিট ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) অপরাধ দমনে সবচেয়ে দক্ষতা সম্পন্ন এই ইউনিটের অতিরিক্তি পুলিশ কমিশনার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তাকে বলা হতো ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম হাতিয়ার। পুলিশ পরিচয়ে ক্ষমতাশীন দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েলে হারুনের ভূমিকা ছিল অনন্য। শুধু হারুন না পুলিশ বাহিনীতে এমন শত শত কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনী হয়ে কাজ করেছেন। ফলে আওয়ামী লীগের পতনের পরও তারাও চলে গেছেন আড়ালে। কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আবার কেউ দেশেই আছেন আত্মগোপনে। আবার দেশ ছাড়তে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন ২৫ পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশের পলাতক কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তাকে এখনো চাকরিচ্যুত করা হয়নি। পলাতক হিসেবে হারুনকে পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকায় এক নম্বরে রাখা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, কাজে যোগ না দেওয়া শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে হারুন ছাড়াও আছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান (স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসরের আবেদন করেছেন), ডিএমপির সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার।
পুলিশ সুপার থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আত্মগোপনে থাকা অন্য আট কর্মকর্তা হলেন:
আরপিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আবু মারুফ হোসেন, আরপিএমপি ডিবির উপ-পুলিশ কমিশনার মো. শাহ নূর আলম, ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান ও মো. ইফতেখার মাহমুদ, আরএমপি সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান ও মো. আল ইমরান হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার রানা।
পরিদর্শক পদে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া কর্মকর্তারা হলেন:
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি মো. মাহফুজার রহমান, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক খাদেমুল বাহার বিন আবেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সার্কেলের পরিদর্শক মো. ইউসুফ হাসান, ডিএমপির সাবেক পরিদর্শক জাকির হোসাইন ও ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।
৫ আগস্টের আগে-পরে সংঘটিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামির তালিকায়ও শীর্ষে হারুন অর রশীদ। এসব মামলার মধ্যে ২০১১ সালে যে ঘটনাকে কেন্দ্র এই কর্মকর্তা লাইমলাইটে আসেন সেই তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নাল আবদিন ফারুককে নির্যাতনের মামলাও আছে।
পুলিশ সদর দফতরের গ্রেফতারের তালিকায় ৯০ জন পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। যাদের মধ্যে ২৫ জন গ্রেফতার হয়েছেন। বাকিদের অনেকেই আছেন আত্মগোপনে। গুঞ্জন রয়েছে গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ ছেড়েছেন। আবার কেউ শিক্ষা ছুটি, কেউবা অসুস্থতার কথা বলে কিংবা লিয়েন (অনুমোদন নিয়ে অন্যত্র চাকরি) নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
গ্রেফতারের তালিকায় আলোচিত আরও কর্মকর্তারা:
গ্রেফতারের অনুমতি নেওয়া পুলিশ সদস্যের তালিকায় আরও আছেন- ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, ওয়ারী জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এস এম শামীম, উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলাম, ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের সাবেক সহকারী কমিশনার তানজিল আহমেদ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উত্তরার সহকারী পুলিশ সুপার (চট্টগ্রামের হাটহাজারী মডেল থানার সাবেক ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য বলছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে কাজে যোগ দেন নি ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে একজন ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ৭ জন, পুলিশ সুপার ২ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১ জন, সহকারী পুলিশ সুপার ৫ জন, পুলিশ পরিদর্শক ৫ জন, এসআই ও সার্জেন্ট ১৪ জন, এএসআই ৯ জন, নায়েক ৭ জন এবং কনস্টেবল রয়েছেন ১৩৬ জন।
এ ছাড়া ১৮৭ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে ছুটিতে অতিবাস ৯৬ জন, কর্মস্থলে গরহাজির ৪৯ জন, স্বেচ্ছায় চাকরি ইস্তফা দিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ৩ জন এবং অন্যান্য কারণে ৩৯ জন কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন বলেও পরিসংখ্যানটিতে জানানো হয়।
আত্মগোপন থাকায় অবস্থায় বাধ্যতামূলক অবসরে ২৩ পুলিশ কর্মকর্তা:
৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামানসহ শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ২৩ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অবসরে যাওয়ার আগে তাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে ছিলেন।
এ দিকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর অন্তবর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যেসব পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, লুকিয়ে আছেন, তাদের আর যোগ দিতে দেওয়া হবে না।
আত্মগোপনে থাকা সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত কর্মকর্তাদের সংখ্যা ১৮৭ জন। তবে পরবর্তীতে তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তাদের বিষয়ে সদর দফতর কাজ করছে। বিস্তারিত আপডেট আপনাদের জানানো হবে।