দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ
-
-
|

ছবি: সংগৃহীত
ব্যাংকিং খাতের অন্যতম সমস্যা হিসেবে বিবেচিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে যা বেড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা হয়েছে। এটা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ শতাংশ। এ সময় পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম, খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে না। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার বেশ কিছুটা বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। এটা আগামীতে আরও বাড়বে। খেলাপি ঋণের যে সর্বোচ্চ চূড়া, সেখানে আমরা এখনো পৌঁছাইনি। আরও কিছুটা সময় লাগবে। আমাদের কাছে যতই নতুন তথ্য আসছে, ততই বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
তিনি বলেন, নতুন আইন কার্যকর হলে অর্থাৎ ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিন করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। এটা আশঙ্কা না বাস্তবতা, আগামীতে আমরা সেদিকেই যাব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। আগের বছর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩২ কোটি টাকা। আর আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। এর আগের তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৭৩ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। এর মানে গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।
তথ্যে আরও দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এই হার আগের প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে কিছুটা বেড়ে হয়েছে ৪২ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই হার ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকগুলো থেকে গত দেড় দশকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই এখন আর ফেরত আসছে না। এর প্রভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এতদিন খেলাপি ঋণের তথ্য লুকিয়ে রাখার যে প্রবণতা ছিল, এখন সেটা নেই। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এতে আগামীতে খেলাপি ঋণের হার আরও বাড়বে। এতে সার্বিকভাবে সংকটে পড়বে ব্যাংক খাত তথা অর্থনীতি।
এর আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হলো খেলাপি ঋণ। এ ঋণের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রণগত ঘাটতি ও অর্থ পাচারের মতো অপরাধ তথা শোষণমূলক অনুশীলন বড় ভূমিকা রেখেছে।
জানা গেছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। আর শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের মাস তথা গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার। ৯৭৭ কোটি টাকায় ঠেকে, যা প্রায় ১৩ গুণ বেশি। এ ঋণের বাইরেও প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়। আর খেলাপি কম দেখাতে গত কয়েক বছরে বাছবিচার ছাড়াই লাখ লাখ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল ও ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশ তথা ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ আগে থেকেই 'দুর্দশাগ্রস্ত'।
অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পরই দেশের ব্যাংক খাতের ক্ষত ফুটে উঠতে শুরু করে। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার দেখানো হয়েছে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। জুনে সেটি ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশে ঠেকে। আর ডিসেম্বরে এসে খেলাপি ঋণের এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশ।
এই প্রসঙ্গে অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রথমত, এখন তথ্য গোপন করা হয় না, অর্থাৎ তথ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসা বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো না। কারণ ব্যবসায়ীদের অনেকে জেলে আবার অনেকে পলাতক। যার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেমে গেছে। অর্থাৎ নতুন ঋণ বিতরণ হচ্ছে কম, খেলাপি হচ্ছে বেশি।
তিনি বলেন, ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশনের পরিমাণ বাড়ে। এটা যদি মুনাফা থেকে মেটানো না যায়, তাহলে মূলধনের ওপর প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ মূলধন কমে যায়। তখন ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো ডিভিডেন্ড দিতে পারে না। ফলে শেয়ারের দাম কমে যায়।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের নতুন নিয়ম কার্যকর হলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে, যা ৩০-৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
একই বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, গভর্নর নিজেই বলেছেন খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে খেলাপি ঋণের হার এর চেয়েও বেশি হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে ১২টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে, সেগুলোয় এখন নিরীক্ষা চলছে। ওই ব্যাংকগুলোর কত শতাংশ ঋণ নিয়মিত থাকবে, সেটিই বড় বিষয়।
তথ্যসূত্র- খবরের কাগজ'র সৌজন্যে।