বেদনার্ত রবীন্দ্রনাথ
-
-
|

ছবি: বার্তা২৪.কম
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের [(বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮-২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮), (খ্রিস্টীয় ৭ মে, ১৮৬১-৭ আগস্ট, ১৯৪১)] ‘দুখের তিমিরে যদি জ্বলে মঙ্গল আলোক, তবে তাই হোক’, উদ্ধৃতিটি কেবল কথার কথা নয়, স্বয়ং বক্তার ক্ষেত্রে খুবই বাস্তব ও জীবন-ঘনিষ্ঠ। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর প্রায় সব গল্প-উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে অশ্রুজল, বিচ্ছেদ, মৃত্যু এবং নিখোঁজ-নিরুদ্দেশের ঘটনায়। বেদনা, অতৃপ্তি, অসুখ মানে দুঃখই শেষ পর্যন্ত পক্ষবিস্তারী হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ অকারণে বলেন না, বাহিরে যার হাসির ছটা, ভেতরে অশ্রুজল অথবা অন্তরে যার হাসির ছটা বাইরে অশ্রুজল।’ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরের উত্তর প্রান্তের বিখ্যাত ও বনেদি জমিদার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিলেও ব্যক্তিগত জীবনে প্রকৃতার্থেই তিনি ছিলেন একজন বেদনার্ত মানুষ।
অতি অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক প্রতিশ্রুতি লক্ষণীয় এবং তিনি প্রথম উপন্যাস রচনা করেন ২২ বছর বয়সে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসসহ তাঁর অন্যান্য রচনা সম্ভার যেমনিভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি তাঁর সাহিত্যে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং তাতে আনন্দের কথা পাশাপাশি উত্থাপিত হলেও সে আনন্দকে উপলব্ধি করা হয় দুঃখের সীমানায় দাঁড়িয়ে। কারণ, রবীন্দ্রনাথের শুরুটা দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস আর স্মৃতিবিধুরতায়। তাঁর জীবন ও ইতিহাসের পরতে পরতে লুক্কায়িত বেদনার চোরাগুপ্তা¯্রােত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ‘বৌঠান’ কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হয় ৮ বৈশাখ ১২৯১ বঙ্গাব্দে। সে বছরের কার্তিক মাসে লেখা ‘ঘাটের কথা’ এবং অগ্রহায়ণে ‘রাজপথের কথা’। প্রথমটি ‘ভারতী’তে এবং পরেরটি ছাপা হয় ‘নবজীবন’-এ। প্রথমটির নায়িকা কুসুম এবং দ্বিতীয়টির এক অনাম্নী বালিকা। উভয় গল্পেই পূর্বাপর দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস এবং স্মৃতিবিধুরতার রাজত্ব।
পরবর্তীতে মানুষের দুঃখ এবং মানুষের আনন্দের চিত্রণে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ সামাজিক হয়ে উঠেছেন। তাঁর বাল্যের উপনিষৎ-স্পৃষ্টতাকে ধীরে ধীরে কার্যকারণের সম্বন্ধসূত্রে গ্রথিত করেন তিনি। কাব্যজগতের ব্যক্তিকতাকে রবীন্দ্রনাথ মুক্তি দেন তাঁর কথাসাহিত্যে। যে শোকের ধাক্কায় তাঁর কথা-পথে প্রবেশ সে শোক সামলে তিনি পৌঁছান অন্য এক বৃহত্তর উপলব্ধিতে, যেখানে সুখ-দুঃখের কারণ বহু। সেখানে মনে-মনে দ্বন্দ্ব, জনে-জনে দ্বন্দ্ব, ধনে-জনে দ্বন্দ্ব, মনে-জনে দ্বন্দ্ব এরকম বহু দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপ্রবাহ। মানুষের জীবনের সেই দ্বন্দ্বের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গল্পে-উপন্যাসে। মানুষের মনের গভীরে এবং সমাজের বিস্তৃত পরিসরে তল্লাশি চালান রবীন্দ্রনাথ। পরিণামে দ্বন্দ্ব-প্রতিক্রিয়াজনিত যে-দুঃখের সন্ধান পাওয়া যায় তার কারণ কবির চারপাশে থাকা মানুষজনই। আরেকটি কারণ অন্যটি নিহিত সমকালিনতায়।
উপন্যাস সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া ও উপলব্ধিতেও উপরোক্ত মূল্যায়নের সমর্থন লক্ষণীয়: ‘নরনারীর ভালোবাসার গতি ও প্রকৃতি কেবল যে নায়ক-নায়িকার চরিত্রের বিশেষত্বের উপর নির্ভর করে তা নয়, চারি দিকের অবস্থার ঘাতপ্রতিঘাতের উপরেও।...বাইরের এই অবস্থা যেটা আমাদের রাষ্ট্রপ্রচেষ্টার নানা সংঘটনে তৈরি, সেটার অনেকখানি অগত্যা আমার নিজের দৃষ্টিতে দেখা, ও তার কিছু কিছু আভাস আমার নিজের অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করেছে।’
সমকালের প্রভাব রবীন্দ্র সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। তাঁর প্রতিটি রচনাই সমকালের জিজ্ঞাসাকে ধারণ করেছে, উত্তর খুঁজেছে। প্রসঙ্গত, ‘গোরা’ বহুমাত্রিক ও কর্মপ্রবণ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসই শুধু নয়, বরং ৭৬ পরিচ্ছেদে রচিত সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাসও। ‘প্রবাসী পত্রিকায় ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে ‘গোরা’ প্রকাশ শুরু হয় এবং শেষ হয় প্রায়-আড়াই বছর পর ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায়, যা ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সালের মধ্যকার সময়সীমাভুক্ত। উপন্যাস রচনার প্রেক্ষাপটটি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, যাকে ইংরেজগণ ক্ষুদ্রার্থে সিপাহী যুদ্ধ নামে চিহ্নিত করে, তার অর্ধ-শতক পর এবং উপমহাদেশ তথা অবিভক্ত বাঙলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের সমকালীন।
শতবর্ষেরও অধিককাল আগে রচিত অসামান্য এই মহাকাব্যিক উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য মূল চরিত্র গোরা’র আত্মপরিচয় সন্ধান হলেও বহুস্বরিক ও অনেকার্থ-দ্যোতনায় সমৃদ্ধ এই উপন্যাসে এমন আরও অনেক অনুষঙ্গ রয়েছে, যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং বহুবিধ রাজনৈতিক পরিসরকে স্পর্শ করেছে। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনকেও নানা কারণে বেদনার্ত করেছে।
১৩১৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে ‘গোরা’র প্রকাশ শুরুর কয়েকমাস পরে অগ্রহায়ণে রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। পরের চারমাস দুই মেয়েকে নিয়ে শিলাইদহে কাটিয়েছিলেন তিনি। শুধু পদ্মার প্রাকৃতিক শুশ্রূষার জন্যে নয়, কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িত হয়েছিলেন। ভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে নিজের মতো করে অনুধাবন করেছিলেন তিনি, যার ফলে উপন্যাসের ভাবনা-প্রেক্ষিত যুগপৎ আরও অন্তর্মুখী ও বহিরাশ্রয়ী হতে পেরেছিল।
বৌঠান কাদম্বরী, পত্নী মৃণালিনী, কন্যা বেলা, রেণুকা, পুত্র শমী ও দৌহিত্র নীতীন্দ্রনাথ এবং আরও অনেক অপ্রয়োজনের মৃত্যুর অভিঘাত তাঁর জীবনে এসেছে কিন্তু সর্বাবস্থায় তিনি ছিলেন অবিচল স্থিতপ্রজ্ঞ। ঔপনিষদিক চেতনায় নিষিক্ত রবীন্দ্রনাথের কাছে সুখ-দুঃখ উভয়ই সমতুল্য। বরং সুখের চেয়ে দুঃখই তাঁর কাছে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি জানতেন দুঃখ সমুদ্রের গভীর অতলেই রয়েছে অমৃতের উৎস। দুঃখ-সমুদ্রে ডুব দিয়ে তাকে মন্থন না করলে অমৃতের অধিকারী হওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের দুঃখচেতনা তার গভীর জীবনবোধের পরিচায়ক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর মোট ৯৫টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫টি গান যথাক্রমে ‘গল্পগুচ্ছ’ ও ‘গীতবিতান’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২টি খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য ১৯ খণ্ডে ‘চিঠিপত্র’ সংকলনে ও অন্য চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী (১৯১৩) এই সাহিত্যের রচনাসমূহ বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েও প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ যে ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছেন, সেগুলো হলো: বৌ ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষি (১৮৮৭), চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), প্রজাপতির নির্বন্ধ (১৯০৮), গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুই বোন (১৯৩৩), মাল (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪)। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো তাঁর উপন্যাসগুলোও মাসিকপত্রের চাহিদা অনুযায়ী নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, সবুজ পত্র, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
বিষয়বস্তুগত দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘বৌ ঠাকুরাণী হাট’ ও ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস দুটি ঐতিহাসিক। ‘চোখের বালি’ এক অকাল-বিধবার অবৈধ প্রণয়কে কেন্দ্র করে একাধিক চরিত্রের মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আবর্তিত। ‘নৌকাডুবি’ জটিল পারিবারিক সমস্যাকে ঘিরে রচিত, যা কাহিনীর গতিশীলতার জন্য উজ্জ্বল। ‘গোরা’ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রূপে বিবেচিত এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদের সনাতন হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের সংঘাত, ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক সমস্যাবলী, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন ও আত্মপরিচয়ের সঙ্কটের মতো গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে আশ্রয় করে রচিত। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের বিষয়বস্তুও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময়কালে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের জটিলতাকে মূর্ত করেছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা আরও সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর পরবর্তী ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে। ‘চতুরঙ্গ’ রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পধর্মী উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত। ‘শেষের কবিতা’ মূলত প্রেমের উপন্যাস। স্ত্রীর অসুস্থতার সুযোগে স্বামীর পর-নারীর প্রতি আসক্তির বিষয়ের আখ্যান ‘দুই বোন’ ও ‘মাল ’, এতে প্রেম, বিশেষত পরকীয়া বা বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রথমটি মিলনান্তক ও দ্বিতীয়টি বিয়োগান্তক। রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’ও রাজনৈতিক মেজাজ ধারণ করলেও তৎকালীন বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাসের আমেজে ঋদ্ধ।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথের প্রায়-সব গল্প-উপন্যাসের পরিসমাপ্তি বিয়োগান্তক এবং কাহিনীর বিন্যাস ও আবর্তে বিষাদ-বেদনার প্রাবল্য লক্ষণীয়। আখ্যাতের মধ্যে হাস্যরস থাকলেও তাকে ছাপিয়েছে অশ্রুজল, বিচ্ছেদ, মৃত্যু এবং ক্ষেত্র বিশেষে নিখোঁজ-নিরুদ্দেশের মর্মান্তিক ঘটনায়। বেদনা, অতৃপ্তি, অসুখ, দুঃখই শেষ পর্যন্ত পক্ষবিস্তারী হয়ে ওঠে রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের পাতায় পাতায়। বেদনার্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনের মতোই তাঁর সাহিত্যে হাসির খানিক ছটা থাকলেও ভেতরে ভেতরে অশ্রুজলের তীব্র প্রবহমানতাই বড় হয়ে দেখা যায়।