মার্কিন-তালেবান শান্তি চুক্তি: শান্তি যেখানে অনিশ্চিত
-
-
|

ছবি: বার্তা২৪.কম
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির মধ্যে অন্যতম আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হল মার্কিন-তালেবান শান্তি চুক্তি। এরই মধ্যে এই চুক্তিকে ঘিরে বিশ্লেষকদের মধ্যে শুরু হয়েছে নানামাত্রিক বিশ্লেষণ। তবে সব বিশ্লেষণকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে তা হল এই চুক্তি আদতে আফগানিস্তানে কতটুকু শান্তি আনতে সক্ষম? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এই ধরনের চিন্তা একেবারে যে অমূলক নয় সেটি আফগান-মার্কিন সম্পর্কের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলসহ দেশের অন্যান্য অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। সেই সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদরা বিদ্রোহ করে বসে। তৎকালীন সময়ে ওসামা বিন লাদেনের মত কিছু আরব নাগরিক সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে জিহাদের নামে আফগান মুজাহিদদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ওই সময়ে মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে দিন দিন আফগান মুজাহিদরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
আফগানিস্তানের মুজাহিদদের আমেরিকার সাহায্যের অন্যতম কারণ ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভীতি। এই সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতেই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে আমেরিকা তৈরি করে তালেবান নামক বাহিনীকে। এ সময় তালেবানরা আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহায়তায় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতে সক্ষম হয়। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই আমেরিকার মদদে গড়া বাহিনী আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাড়াতে যে তালেবানি শক্তির উত্থান আমেরিকা ঘটিয়েছিল সেই তালেবানি শক্তিই আমেরিকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের টুইনটাওয়ারে ২০০১ সালে সন্ত্রাসী হামলা চালায় আল-কায়েদা। সেই হামলার পর ওই বছর ই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে অভিযান চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখানে উল্লেখ্য যে আফগানিস্তানে চালানো অভিযান ছিল দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর দ্বিতীয় দীর্ঘতম যুদ্ধ।
প্রায় দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে আমেরিকাকেও দিতে হয়েছে চড়া মাশুল। সব মিলিয়ে ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৮২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের ঘাঁটি হিসেবে পাকিস্তানকে ব্যবহার করলেও সেখানকার ব্যয় ধরা হয়নি এই হিসাবে। যদিও ব্রাউন ইউনিভার্সিটির যুদ্ধ প্রকল্পের ব্যয় বা “কস্ট অব ওয়্যার” প্রজেক্ট নামে এক গবেষণার দাবি ছিল ভিন্ন। সেখানে দাবি করা হয় আফগান যুদ্ধে মার্কিনীরা যে ব্যয় দেখিয়েছে তা ছিল প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম। যুক্তি হিসেবে তারা উল্লেখ করে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের জন্য মার্কিন কংগ্রেস এক ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন করেছিল।
আমেরিকান ইতিহাসের এই অন্যতম দীর্ঘ যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল চালিয়ে যাওয়া আমেরিকার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে মার্কিনীদের ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা, যে যুদ্ধ প্রায় ১০ বছর চলেছিল এবং সেই যুদ্ধে প্রায় ৫৩ হাজার সৈন্য নিহত হওয়ার পর জনগণের প্রবল চাপে মার্কিন প্রশাসন লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী দীর্ঘদিন থেকেই পলায়নের পথ খুঁজছিল আফগানিস্তান থেকে। সব মিলিয়ে আমেরিকা কিছুটা কোণঠাসা হয়েছে পড়েছিল ।
যদিও ভৌগোলিকভাবে আফগানিস্তান একটি রুক্ষ অনুর্বর মরুসদৃশ পাহাড়-পর্বতসঙ্কুল দুর্গম দেশ। কিন্তু দেশটি তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। ভৌগোলিকভাবে আফগানিস্তান খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধশালী হওয়ার কারণে ঐতিহাসিকভাবে দেখতে পাই যে, বিভিন্ন সময়ে বিদেশি কুচক্রীদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আফগানিস্তানের ওপর।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী এবং নিকট অতীতে সোভিয়েত দখলদারেরা আফগানিস্তানে বিন্দুমাত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে শক্তিশালী মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতা ও নাস্তানাবুদ হওয়া একবারেই অবাক হওয়ার মত কোন ঘটনা নয়। সন্ত্রাসবাদের বিভিন্ন কলাকৌশল ও পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হল "এট্রিশন'", যার প্রায়োগিক অর্থ হচ্ছে ক্রমাগত প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা। হতে পারে সেই আক্রমণটি ছোট পরিসরে, তবুও আক্রমণটি চালিয়ে যাওয়া।
এই ক্রমাগত আক্রমণের ফলে প্রতিপক্ষের আর্থিক অবস্থা চাপের মুখে পরে এবং সৈনিকদের মনোবলও ভেঙ্গে যায়। এই কৌশল অবলম্বনের কারণে সামরিক ও অর্থনৈতিক, উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী তালেবানদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পোস্ট কর্তৃক প্রকাশিত এক মার্কিন গোপন নথিতে দেখা যায়, মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা স্বীকার করেন আফগানিস্তান যুদ্ধ তাদের কৌশলগত ভুল ছিল এবং আফগানিস্তানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে গিয়ে তাদের বহু অর্থের অপচয় ঘটেছে।
এই ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সাল থেকে তালেবানদের সঙ্গে কাতারের দোহায় অনেকবার আলোচনা হয়। সব শেষে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানদের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসন এক সমঝোতায় পৌঁছায়। এই চুক্তির ভিত্তিতে আগামী ১৪ মাস আফগানিস্তানে তালেবানরা চুক্তির শর্ত মেনে চলবে। যদি ওই সময়ের মধ্যে তালেবানরা চুক্তি মেনে চলে, তাহলে আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্ত চুক্তি করবে এবং তাদের সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।
তবে মার্কিন-তালেবান চুক্তি হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে প্রশ্নটি জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো- মার্কিন-তালেবানদের এই চুক্তি কি সফল হবে? এই চুক্তির আদৌ কোন ভবিষ্যৎ আছে? কারণ সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আফগানিস্তানে তালেবান ছাড়াও আরও অনেক জঙ্গি বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। সেই সব জঙ্গি বাহিনী কতটুকু সফল হতে দেবে এই চুক্তি সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৯০ দশকে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বেশ আশাব্যঞ্জক এক শান্তি আলোচনা শুরু করেছিল। কিন্তু তৎকালীন হামাস জঙ্গি এবং ফিলিস্তিনি জঙ্গিদের বোমাবর্ষণ ও অব্যাহত জঙ্গি কার্যক্রমে ভেস্তে যায় সেই শান্তি আলোচনা। ঠিক সে রকম লক্ষণ বর্তমান আফগানিস্তানেও বিরাজমান।
চুক্তির পর থেকেই আফগানিস্তান বেশ সহিংস হয়ে ওঠে, এমনকি মার্কিন বিমান হামলার ঘটনাও ঘটে। এই সহিংসতার রেশ ধরে গত ৬ মার্চ বিরোধীদলীয় নেতা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর এক জনসভায় বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনা ঘটে এবং এই দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠন আইএস।
যেহেতু ইতোমধ্যে আইএস হামলার দায় শিকার করে নিয়েছে, তাই হতে পারে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানকে তাদের একটি শক্ত ঘাটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন-তালেবান চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
মার্কিন-তালেবান শান্তি চুক্তির ফলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির যায়গায় পতিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল বর্তমান আফগান সরকার। এই চুক্তিতে অনেক বিষয়েই রয়েছে অস্পষ্টতা। এই অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে বেশ কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে যেমন পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের শাসনপদ্ধতি কেমন হবে, বিশেষ করে চুক্তি অনুসারে ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহার করা হলে তখন কাবুলের বর্তমান সরকারের ক্ষমতার পরিধি কেমন হবে, তালেবানদের সমাজে কিভাবে পুনর্বাসিত করা হবে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সংবিধান কিরূপ হবে। এসব বিষয়ে স্পষ্টভাবে চুক্তিতে কিছু বলা নেই। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই আফগানিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির এক উক্তির মাধ্যমেই বোঝা যায়, বর্তমান সরকার এই চুক্তি নিয়ে কতখানি হতাশ। চুক্তির শর্তে রয়েছে, ৫০০০ তালেবান জঙ্গি, যারা আফগান সরকারের হাতে বন্দী, তাদের মুক্তি দিতে হবে। সেই হতাশা থেকে আশরাফ ঘানি বলেছেন, অপরাধীকে মুক্ত করে দিতে হবে, এমন শর্ত চুক্তিতে থাকা উচিত নয়।
অপরদিকে তালেবানরা গণতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও তাদের লক্ষ্য একেবারেই ভিন্ন। তালেবানদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শরিয়াহ আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। তাই বর্তমান আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানদের আদর্শগত চূড়ান্ত বিরোধ রয়েছে। নারী নেতৃত্ব ও নারী অধিকার নিয়েও বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মধ্যে রয়েছে বিরোধ। তাই তালেবানদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা কতটা বাস্তবসম্মত, সেটা নিয়েও রয়েছে সংশয়। কারণ, তালেবানদের পক্ষে তাদের মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। যদি কখনো শান্তির স্বার্থে তারা সরে আসতেও চায়, তাহলে তাদের অভ্যন্তরেই ভয়াবহ সংঘাত সৃষ্টি হবে।
সর্বোপরি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই চুক্তির মূল সংকটের জায়গা তৈরি হবে দুই বিপরীতমুখী আদর্শে বিশ্বাসী দুই গোষ্ঠীর সমঝোতাকে কেন্দ্র করে। এই কথা অনস্বীকার্য যে তালেবান এবং বর্তমান আফগান সরকার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আদর্শে বিশ্বাসী দুইটি গোষ্ঠী এবং এই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আদর্শে বিশ্বাসী দুইটি গোষ্ঠীর সম্পর্ক বা সমঝোতা কিভাবে হবে তার রূপরেখা চুক্তিতে না থাকার ফলে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। যা যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান শান্তি চুক্তিকে করবে মূল্যহীন। আফগানিস্তান নামক রাষ্ট্রে শান্তির অভিপ্রায়ে দুই বিপরীতমুখী গোষ্ঠী কতটা আন্তরিকভাবে এই সংকটগুলো সমাধানে কাজ করবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
মনিরা নাজমী জাহান: শিক্ষক, আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়