মুঘল হেরেমের রহস্যময়ী নর্তকী আনারকলির মৃত্যু নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। কেউ বলেন, শাহজাদা সেলিমের সঙ্গে প্রেম ও প্রণয়ের জন্য তাকে জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন সম্রাট আকবর। কারো মতে, তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। অনেকের মতে সুড়ঙ্গপথে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল অজানা ঠিকানায়।
চলচ্চিত্রের রূপালি পর্দায় আনারকলি হয়েছিলেন মধুবালা তথা মমতাজ জাহান দেহলভী (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩ - ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার। সে মৃত্যও বেদনায় বিদীর্ণ। আজ তার মৃত্যুদিনে রূপালি পর্দার আনারকলির বেদনাও স্পর্শ করছে সবাইকে।
যিনি মধুবালা নামেই বেশি পরিচিত, তিনি ছিলেন একজন অন্যতম ভারতীয় অভিনেত্রী। তিনি অনেক হিন্দি ধ্রুপদী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার সমসাময়িক নার্গিস এবং মীনা কুমারীর বিপরীতে তাকে হিন্দি চলচ্চিত্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের সর্বাধিক সুন্দর-আকর্ষণীয় অভিনেত্রী হিসেবেও গণ্য হন। পরিচিত হন 'ভেনাস অব বলিউড' নামে।
৩৬ বছরে জীবনে দীর্ঘ ৯ বছর হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে বিছানা নিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের আনারকলি নামে খ্যাত মধুবালা। তবে শুধু চলচ্চিত্রেই নয়, বাস্তবেও সেলিমের বা দিলীপ কুমারের প্রেমে পড়েন মধুবালা। দীর্ঘ সাত বছর চলেছিল তাদের প্রেমপর্ব। এই সম্পর্ক আকস্মিক ভেঙে যায়।
একটি ছবির শ্যুটিং চলছে। বাইরে মধুবালাকে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না তার বাবা। পরিচালক-প্রযোজক অনুরোধ করেন দিলীপ কুমারকে। তিনি যেন এই প্রসঙ্গে মধুবালার বাবার সঙ্গে কথা বলেন। দিলীপ কুমার এই নিয়ে মধুবালার বাবার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি অভিনেতাকে অপমান করেন। মধুবালাও এ ক্ষেত্রে দিলীপ কুমারের পাশে দাঁড়াতে পারেননি। মধুবালার বক্তব্য ছিল, দিলীপ কুমার নয়, তার বাবা আতাউল্লাহ খান-ই তার প্রেমিকের কাছে অপমানিত হয়েছেন। মধুবালা স্পষ্ট জানান, তিনি তার বাবার বিরুদ্ধাচারণ করতে পারবেন না। তিনি দিলীপ কুমারকে অনুরোধ জানান, তার বাবার কাছে এই আচরণের জন্য ক্ষমা চাইতে।
দুইজনের মিলন আর হয়নি বাস্তবে। ইতিহাসের সেলিম-আনারকলির প্রেমের মতোই দিলীপ কুমার-মধুবালার দীর্ঘ প্রেম অতৃপ্তির হাহাকারে গুঞ্জরিত হয়। কে. আসিফ পরিচালিন বলিউডের ইতিহাস সৃষ্টিকারী 'মুঘল-ই-আজম' ছবিতে সেসব বিধৃত রয়েছে। 'আনারকলি: মুঘল হেরেমের রহস্যময়ী নারী' শীর্ষক সর্বসাম্প্রতিক গ্রন্থের লেখক ড. মাহফুজ পারভেজ শাহজাদা সেলিম-আনারকলির প্রেমের মতো দিলীপ কুমার-মধুবালার দীর্ঘ প্রেমের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। এবারের ২০২২ সালের একুশের গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে ৭০ বছরের প্রাচীন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্টুডেন্ট ওয়েজ। বইটি রকমারি.কম-এ পাওয়া যাচ্ছে।
ইতিহাসের ভাষ্যানুযায়ী, আনারকলি ছিলেন একজন পৌরাণিক দাসী কন্যা। জন্মসুত্রে তার নাম নাদিরা বেগম অথবা শার্ফ-উন-নিসা। ধারণা করা হয় যে, আনারকলি কোনও এক বণিক বহরের সাথে ইরান থেকে মুঘল ভারতে অভিবাসিত হয়েছিলেন। তারপর স্থান লাভ করেন মুঘলদের রাজকীয় হেরেমে। সেখানে শাহজাদা সেলিমের সঙ্গে তার বিয়োগান্তক প্রেমের করুণ আখ্যান সর্বজনবিদিত। একইভাবে তার জন্ম, পরিচিতি ও মৃত্যু সম্পর্কেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন করুণ বিবরণ।
ড. মাহফুজ পারভেজ জানান, বলিউডের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র কে. আসিফের 'মুঘল-ই-আজম'- আনারকলির জীবনালেখ্য। শাহজাদা সেলিমের সাথে (যিনি পরবর্তিতে সম্রাট জাহাঙ্গীর হয়েছিলেন) প্রেম ও প্রণয়ের সম্পর্ক স্থাপনের অপরাধে মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে দুটি ইটের দালানের মধ্যখানে জীবন্ত কবরস্থ করার মর্মন্তুদ ঘটনা চিত্রিত হয়েছে চরম নাটকীয়তায় ও রোমাঞ্চে। আনারকলি চরিত্রে 'ভেনাস অব বলিউড' নামে খ্যাত মধুবালা এবং শাহজাদা সেলিম চরিত্রে 'ট্র্যাজিডি কিং' দিলীপ কুমারের স্মরণীয় অভিনয় এবং প্রেমের ঘটনাও অম্লান হয়ে আছে।
আশ্চর্যজনকভাবে, কোনও বিশেষ প্রমাণ বা তথ্যসূত্র না থাকায় আনারকলি সম্পর্কিত ঘটনা অধিকাংশের নিকট মিথ্যা ও অনৈতিহাসিক বলে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া আনারকলি উপাখ্যান মুঘল ইতিহাস গ্রন্থ 'আকবরনামা' অথবা 'তুজক-ই-জাহাঙ্গীর'-এর কোথাও উল্লেখিত হয়নি। কিন্তু আনারকলির সম্বন্ধে প্রথম জানা যায় ইংরেজ পর্যটক ও বণিক উইলিয়াম ফেঞ্চের সাময়িকী থেকে, যিনি তৎকালে শাহজাদা সেলিম বা সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে আগস্ট ২৪, ১৬০৮ সালে মুঘল ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের উর্দু ভাষী বিশাল অঞ্চলে, বিশেষত লখনৌ, আগ্রা, দিল্লি, লাহোরের জনশ্রুতিতে আনারকলি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মব্যাপী পরিচিত একটি নাম হয়ে এখনও বিদ্যমান। তাকে ঘিরে রচিত হয়েছে বহু নাটক, সিনেমা ও গ্রন্থ। লাহোরে রয়েছে আনারকলির মাকবারা বা সমাধিসৌধ। রয়েছে প্রাচীন আনারকলি বাজার। শাড়ি, ব্লাউজে আনারকলি ডিজাইন এখনও মশহুর। এখনও চলচ্চিত্রের আনারকলি মধুবালার করুণ জীবনালেখ্যও মানুষকে আলোড়িত করে।
মধুবালা এখনও অবধি উপমহাদেশের সিনেমার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী। নায়িকা মাধুরী দীক্ষিত যখন বলিউডে প্রথম এলেন, তখন অনেকেই তার সৌন্দর্যের সঙ্গে মধুবালার তুলনা করেছিলেন। কিন্তু মধুবালার সৌন্দর্য কালজয়ী। মধুবালার সৌন্দর্য ছিল তাঁর অনুরাগীদের নখদর্পণে। তার বোন মধুর ভূষণ এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এসব ঘটনার সাক্ষ্য বহন করেছেন।
যখন মধুবালা রীতিমত নামী নায়িকা, তখনা একদিন বোনদের নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে ফিল্ম দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুপারস্টার মধুবালা সাধারণ ভাবে যেতে পারতেন না। কারণ জানাজানি হয়ে গেলে ‘মবড’ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। ফলে বোরখা পরে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসেছিলেন মধুবালা।
ইন্টারমিশনের সময় স্ন্যাক্স বিক্রি হচ্ছিল প্রেক্ষাগৃহের মধ্যেই। মধুবালা ও তার বোনেরা কিছু স্ন্যাক্স কিনলেও তাদের কাছে কোনো বিক্রেতা দাম নিতে চাইছিলেন না। শেষ পর্যন্ত মধুবালার বোনরা এক বিক্রেতাকে চেপে ধরে জানতে চান, কেন তারা দাম নিচ্ছেন না। সেই বিক্রেতা খোলসা করলেন প্রকৃত ঘটনা।
সেই বিক্রেতা বলেছিলেন, তাদের সঙ্গে স্বয়ং মধুবালা আছেন। ফলে খাবারের দাম নেওয়া যাবে না। মধুর বলেন, মধুবালা কোথায়, ওই ব্যক্তির নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে। বিক্রেতা বলেন, তাদের কোনও ভুল হচ্ছে না। কারণ তারা বোরখা পরিহিত মহিলার পায়ের পাতা দেখে চিনতে পেরেছেন, তিনিই মধুবালা। কারণ অত সুন্দর পা আর কারও হতে পারে না। মধুবালা চমকে ছিলেন কিনা জানা যায়নি, তবে তার বোনরা রীতিমত চমকে গিয়েছিলেন।
নায়িকা হতে চাননি মধুবালা। তার বাবা জোর করে অর্থ রোজগারের জন্য অত্যন্ত শিশু বয়সেই মধুবালাকে অভিনয় জগতে আসতে বাধ্য করেন। পারিবারিক কারণে দিলীপ কুমারের জীবন থেকে সরে গিয়েছিলেন মধুবালা। তবুও অত্যন্ত প্রফেশনাল হয়ে শেষ করেছিলেন ‘মুঘল-ই-আজম’ ফিল্মের শুটিং। আজও আইকনিক হয়ে রয়ে গেছে তা। আনারকলিরূপী মধুবালা গেঁথে রয়েছেন সকলের মনে।