ভারতের পশ্চিম উপকূলের মহারাষ্ট্রের মারাঠি মেয়েটি শুধু সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া নয়, তাবৎ পৃথিবী মাতিয়েছেন কিন্নর কণ্ঠের মোহনীয় মায়াজালের সুরেলা জাদুতে। লতা আর তার বোন আশার গানের তরঙ্গ তাদের জন্মস্থানের সুদূরবর্তী বাংলার ঘরে ঘরেও সমাদৃত। বাঙালি না হয়েও যেমন বাংলায় গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন সুরসম্রাট মোহাম্মদ রফি, সুমন কল্যাণপুর, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অলকা ইয়াগনিক, সাধনা সারগম এবং আরও বহু শিল্পী, তেমনই দৃষ্টান্ত রয়েছে সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকারের। উপমহাদেশে সুরসম্রাজ্ঞী রূপে সমকক্ষ ছিলেন মাত্র দুইজন, ভারতের লতা আর পাকিস্তানের নূরজাহান।
লতা মঙ্গেশকারের মতো বাংলা ও বাঙালির এতো কাছে আসতে পারেন নি অন্য কোনও অবাঙালি শিল্পী। শুরুটা সেই ১৯৪৮ সালে। বম্বেতে তখন নিজের পরিচিতি তৈরি করে নিয়েছেন বাঙালি পরিচালক শশধর মুখোপাধ্যায়। সিনেমা পরিচালনা করছেন, আবার প্রযোজনার দায়িত্বও নিচ্ছেন। গোরেগাঁওয়ে তৈরি করেছেন ‘ফিল্মিস্তান’ নামের প্রসিদ্ধ স্টুডিও। বিখ্যাত লেখক সাদাত হাসন মান্টো, ইসমত চুঘতাই, অশোক কুমার— কে না নেই সেখানে!
এমনই একটা সময় শশধরবাবুর কাছে হাজির হলেন নামজাদা সঙ্গীত পরিচালক গোলাম হায়দার। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বছর উনিশের এক তরুণীকে, মারাঠি পরিবারে জন্ম যার। ইতিমধ্যে বেশ কিছু মারাঠি ও হিন্দি সিনেমায় গান গেয়েছে মেয়েটি। গোলাম হায়দার মুগ্ধ হয়ে তরুণীকে নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন শশধর মুখোপাধ্যায়ের কাছে।
কিন্তু তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি সেদিন। শশধরবাবু কিছুতেই নিতে রাজি হননি মেয়েটিকে। তার বক্তব্য ছিল, 'গায়িকার গলা অত্যন্ত পাতলা। ফলে তিনি কাজ করতে পারবেন না।' এই কথা শুনে রীতিমতো রেগে যান গোলাম হায়দার। প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসেন সেদিন। তিনি জানতেন, এই মেয়ে সবার মন জয় করতে এসেছে। একদিন এমন হবে যে, পরিচালকরা তার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। পৃথিবীজোড়া নাম হবে তার। গোলাম হায়দার খাঁটি জহুরি ছিলেন, হীরে চিনতে ভুল করেননি। সেদিনের উনিশ বছরের সেই মেয়েটির নাম লতা মঙ্গেশকর।
এরপর ১৯৪৮ সালেই তৈরি হয় ‘মজবুর’ সিনেমাটি। লতার সেই ‘পাতলা গলা’ই গেয়ে ওঠে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’। তারপর ইতিহাস এক কিংবদন্তির বেড়ে ওঠার সাক্ষী থাকলো। লতা মঙ্গেশকর নিজেই এক চলমান ইতিহাসে পরিণত হন, যিনি কলম দিয়ে বা যুদ্ধ করে নয়, নিজের গলা দিয়ে, সুর দিয়ে, সৃষ্টির সাধিকা হয়ে সবাইকে ভাসিয়েছেন সুরের অমৃতলোকে।
লতা ছিলেন সত্যিকার অর্থেই সাধক। নিজেই বলেছেন, তার জীবন বুঝতে গেলে তার সাধনাকে কে বুঝতে হবে, শুনতে হবে। সঙ্গীত নিয়েই মেতে ছিলেন জীবনভর। সঙ্গীতের সুরসুধা বিলিয়ে দিয়েছেন আজীবন। নব্বই বছর পেরিয়েও তিনি ছিলেন সুরের চিরতরুণ উপমা।
যদিও গানের জগতে পা দেওয়ার পর প্রথমদিকে এক বাঙালি পরিচালকই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তথাপি লতা বাংলা গান গেয়েছেন গান খুলে। বাংলার সঙ্গে চিরকালের মতো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল লতা’র। সুরে সুরে বম্বে আর বাংলার মধ্যে তৈরি করেন তিনি সুরের সাঁকো।
কবে প্রথম কোন বাংলা ছবিতে লতা প্লেব্যাক করেন, তা নিয়ে বেশ কিছু তর্ক রয়েছে। তবে মনে করা হয়, ১৯৫৬ সালে ‘অসমাপ্ত’ ছবি দিয়েই তার বাংলা গানের জগতে পদার্পণ ঘটে, যাতে দুটি গান গেয়েছিলেন তিনি। তারপর একের পর এক কালজয়ী বাংলা গান করেন লতা। কখনও সলিল চৌধুরী, শচীন দেববর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কখনও আবার রাহুল দেববর্মণ, বাপী লাহিড়ীর সুরে মাতিয়ে দিয়েছেন বাংলার সঙ্গীত জগত।
লতা জন্মগতভাবে বাঙালি ছিলেন না, বাংলাও বুঝতেন না। কিন্তু ভাষাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। একটা ভাষায় গান গাইতে গেলে সেই ভাষা না জানলেও সে ভাষাকে অনুভবের সামর্থ্য থাকতেই হয়। তা না হলে গানটাকেই ছোঁয়া যায় না। এজন্য, শুধু বাংলা শিখবেন বলে বাড়িতে শিক্ষক রেখেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। শিক্ষক হয়েছিলেন বাসু ভট্টাচার্য। দায়সারাভাবে নয়, রীতিমতো লিখতে ও পড়তে যাতে পারেন সেই চেষ্টাই করেছিলেন তিনি। একজন শিল্পীর কত বড় সাধনার শক্তি থাকলে এমন দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, লতা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ ছিলেন।
লতা তার পেশাজীবনের মধ্যগগনে দেখেছিলেন, উপমহাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং বাঙালি পরিচালক-সুরকারদের জয়জয়কার। ব্যক্তিগত জীবনে লতা মঙ্গেশকরও জড়িয়ে গিয়েছিলেন বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। সেইসূত্রেই পরিচয় হয়েছিল প্রবাদপ্রতিম শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। একসময় দুই পরিবারের মধ্যেও ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়।
লতা’র কাছে ঠিক কতটা আপন ছিলেন ‘হেমন্তদা’, সেটা বেশ কিছু ঘটনা থেকেই জানা যায়। যেমন, ১৯৫১ সালে পরিচালক হেমেন গুপ্ত বম্বেতে ডেকে পাঠালেন হেমন্ত-কে। তার ইচ্ছে, পরবর্তী সিনেমা ‘আনন্দমঠ’-এর সুরের দায়িত্বে থাকবেন তিনি। বাংলায় কাজকর্ম মিটিয়ে বম্বে চলে গেলেন হেমন্ত। হাজির হলেন ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে। শশধর মুখোপাধ্যায় তাকে সঙ্গীত পরিচালকের চাকরি দিলেন। ‘বন্দে মাতরম’ গানটা তিনি গাওয়াবেন লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে। শশধরবাবুকে বলতেই তিনি বললেন, লতা হয়তো আসবেন না। পুরনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার?
এদিকে হেমন্ত ঠিক করে ফেলেছেন, এই গান লতা ছাড়া কারোর গলায় গাওয়াবেন না। তাই একবার চেষ্টা করে দেখলে চাইলেন তিনি। শশধর মুখোপাধ্যায় নিমরাজি হলেন। লতা মঙ্গেশকরের কাছে যাওয়ার পর তিনি একটাই কথা বললেন। ‘আমি ওখানে গাইব না ঠিক করেছি, কিন্তু শুধু আপনার জন্যই গাইব’। আর টাকা? না, লতা’র টাকা চাই না। তিনি শুধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করতে চান। এমনকি, রিহার্সাল দিতে সটান চলে গেলেন হেমন্ত’র বাড়ি, যা ছিল লতা’র স্বভাববিরুদ্ধ। জাতশিল্পী লতার এমনই গভীরতর ছিল সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা ও মানবিক স্পর্শকাতরতা।
বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে লতার সম্পর্ক এখানেই থেমে থাকেনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। লতা মঙ্গেশকর তার প্রাণের বান্ধবী। এই সময় বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে 'সাধ' খাওয়ানোর রীতি থাকে। লতা নিজেই দায়িত্ব নিয়ে সেই কাজটি করলেন। হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন তার বান্ধবীকে।
কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সেই হেমন্ত-সন্ধ্যার কথা কেউ ভুলতে পারবে না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। খানিক ইতস্তত করেই লতা’কে ফোন করেছিলেন হেমন্ত। যদি আসতে পারেন। ফোনের ওপাশ থেকে নিজেই উৎসাহিত হয়ে ওঠেন সুরের রানি। তার ‘হেমন্তদা’র’ গানের পঞ্চাশ বছর পূর্তি, আর তিনি আসবেন না, তা কি হয়! অনুষ্ঠানের তিনদিন আগে প্রবল শরীর খারাপ হয় লতার। হয়তো আসতেনই না। কিন্তু ওই যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুষ্ঠান বলে কথা। লতা না এসে থাকতে পারে নি।
গান তাকে ছুটিয়ে নিয়েছে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। মৃত্যুর অনন্তনিদ্রায় চলে গিয়েও তিনি রেখে গেছেন হাজার হাজার গানে গুঞ্জরিত কথামালা, যা সুর-ঝঙ্কারে মনে করায় এক অসাধারণ শিল্পীকে, যিনি বাংলাকে ভালোবেসে ছিলেন, বাংলায় গান গেয়েছিলেন, হৃদয় দিয়ে।