রমজান এলেই বদলে যায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের চিত্র। বিকেলের পর থেকে মসজিদের খোলা বারান্দায় ভিড় জমতে শুরু করে নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষের। কেউ শ্রমজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউবা শিক্ষার্থী—সবাই এক কাতারে বসে ইফতার করেন। আসরের নামাজ শেষে লম্বা সারিতে বসে পড়েন রোজাদাররা, মনোযোগ দিয়ে শোনেন মসজিদের মাইকে ভেসে আসা কোরআন তিলাওয়াত ও বয়ান। আর এরই মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ইফতার পরিবেশনায়। মাগরিবের আজান পড়তেই সবাই একসঙ্গে মুখে তোলেন প্রথম খাবারটি—খেজুর বা শরবত। ধনী-গরিব, পরিচিত-অপরিচিত সব ব্যবধান ভুলে এখানে সৃষ্টি হয় এক অনন্য সম্প্রীতির দৃশ্য। দুই যুগ আগে শুরু হওয়া এই ঐতিহ্য আজ পুরো চট্টগ্রামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন হাজারো রোজাদার এসে অংশ নেন এই গণ-ইফতার আয়োজনে।
২০০৫ সালে মসজিদের খতিব সাইয়্যিদ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল-মাদানী সৌদি আরবের মক্কা-মদিনার আদলে প্রথম এই আয়োজনের উদ্যোগ নেন। শুরুতে ছিল ছোট পরিসরে, কিন্তু ২০০৭ সাল থেকে এটি বড় আকারে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে রমজানজুড়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ এখানে ইফতার করেন এবং রমজানের শেষ দিকে এই সংখ্যা চার হাজারে পৌঁছে।
এই বিশাল আয়োজনের পেছনে রয়েছে কিছু দানশীল মানুষের অবদান, যারা নাম প্রকাশে আগ্রহী নন। মসজিদের খতিবের সহকারী মো. হাসান মুরাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রতিবছর বেশ কয়েকজন বিত্তবান এই আয়োজনের জন্য সাহায্য করে থাকেন। তাছাড়া আরও অনেকেই নিজেদের সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসেন, যার ফলে প্রতিবছর এই আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এখানে কেউ ৫ বস্তা চনা দেয় আবার কেউ আধা কেজি লবনও দেয়।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন আমরা আড়াই হাজার লোকের ইফতারের আয়োজন করছি।রোজার শেষে গিয়ে সেটি বেড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার পর্যন্ত হয়। নিজেদের বাবুর্চি দিয়ে এসব ইফতার তৈরি করা হয়। ৩০-৫০ জন শ্রমিক এই আয়োজনে কাজ করেন।
ইফতারে থাকে নয় ধরনের খাবার—জিলাপি, মুড়ি, খেজুর, শরবত, ছোলা, পেঁয়াজু, আলুর চপ, মরিচা, বেগুনি। মুড়ি, জিলাপি, খেজুর ও শরবত বাইরে থেকে আনা হয়, আর ছোলা, পেঁয়াজু, আলুর চপ মসজিদের নিজস্ব বাবুর্চি দিয়ে রান্না করা হয়। এই কাজের দায়িত্বে আছেন কুমিল্লার লাকসামের ইয়াছিন বাবুর্চি, যিনি ২৪ বছর ধরে এই রান্নার কাজটি পালন করছেন। তাঁর সঙ্গে আরও পাঁচজন সহযোগী কাজ করেন। সকাল ৬টা থেকে রান্নার কাজ শুরু হয়, যা বিরতিহীনভাবে চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
মসজিদের এক কোণে বিশাল ড্রামে শরবত তৈরি করা হয়, যাতে থাকে রুহ আফজা, চিনি এবং বরফ। শরবত তৈরির কাজ করেন মো. শহীদ আলম, যিনি প্রতিবছর এক ব্যবসায়ীর খরচে এই কাজ করেন। প্রতিদিন ১৫ বোতল রুহ আফজা ও ১৫ কেজি চিনি দিয়ে বিশাল ড্রামে শরবত তৈরি করা হয়, যা রোজাদারদের তৃষ্ণা মেটাতে সাহায্য করে।
এই আয়োজনের উদ্দেশ্য শুধু খাদ্য বিতরণ নয়, বরং এক মিলনমেলা সৃষ্টি করা, যেখানে মানুষ জাত, ধর্ম, এবং অবস্থান নির্বিশেষে একত্রে বসে ইফতার করেন। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে এই আয়োজনের অংশ হতে। পথচারী, দিনমজুর, ব্যবসায়ী—সব শ্রেণির মানুষ এখানে একসঙ্গে বসে খাবার ভাগাভাগি করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাকিব হাসান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এখানে এসে মনে হয়, ইফতার শুধু খাবার নয়, বরং এটি এক মহামিলন, যেখানে সবাই একসঙ্গে ভালোবাসা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ইফতার করে।
রিকশাচালক আনিসুল হক বলেন, প্রতিদিন ইফতার কেনার সামর্থ্য থাকে না। এখানে এসে পেট ভরে ইফতার করতে পারি, এর চেয়ে শান্তির কিছু হতে পারে না।
শ্রমিক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা সারাদিন কাজ করি, কষ্ট হয়। এখানে এসে ইফতার করলে মনে হয়, সবাই আমার আপনজন।
চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদে দুই যুগের ঐতিহ্য হয়ে ওঠা এই গণ-ইফতার আয়োজন শুধু খাবারের পরিসীমা বাড়ায় না, বরং একটি সামাজিক শক্তির পরিচয় দেয়। এটি নগরীর সবচেয়ে বড় সম্প্রীতির মিলনস্থল, যেখানে একসঙ্গে সবাই ইফতার করে এবং মানবিকতার জয়গান গায়।