সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য হয়েছে সেনাপ্রধানের বক্তব্য

, জাতীয়

নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2025-02-27 09:17:14

দেশের এই ক্রান্তিকালে গত মঙ্গলবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের দেয়া বক্তব্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে; প্রশংসাও পেয়েছে। তার ওই বক্তব্যকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।

এমন পরিস্থিতে সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্য ‘যুগোপযোগী’ বলে মনে করছেন সুধী সমাজের প্রতিনিধিরাও। তাদের মতে, দেশে যে ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে সেনাপ্রধানের এমন দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য খুবই দরকার ছিল। কারণ ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সরকারপ্রধানের দায়িত্বে থাকার পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আর এই সুযোগে একদিকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে; অন্যদিকে উপর্যুপরি দাবির আন্দোলনের ফলে দেশে একধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে- এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদের কারণেও তৈরি হয়েছে একধরনের অনিশ্চয়তা। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

এমন পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) তার দেওয়া বক্তৃতায় স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে আগামী নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে হওয়া (ইলেকশন শুড বি উইদিন ডিসেম্বর) উচিত। পাশাপাশি একটি ফ্রি, ফেয়ার এবং একটি ইনক্লুসিভ ইলেকশনের কথাও তিনি বলেছেন। এ ছাড়া পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে তিনি পুরো সেনাবাহিনীর ‘স্পিরিট’ বা মনোভাবের কথাই তুলে ধরেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

অনেকের মতে, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ৫ আগস্টের ঘটনার সময়ও সেনাবাহিনীর মনোভাব বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাশাপাশি মঙ্গলবার তার দেওয়া বক্তব্যও সেনাবাহিনীর মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।

তার বক্তব্যে দেশের রাজনৈতিক দল তথা মানুষের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন, বিভেদ ও অনৈক্য দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। অনেকের মতে, তার এই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মোপলব্ধি না ঘটলে পরের উদ্ভূত পরিস্থিতির দায়ও তাদেরই বহন করতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে সেনাপ্রধান পুলিশের পুরোপুরি কাজ না করার কারণ এবং র‌্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের আতঙ্কিত হওয়ার কথা বলেছেন।

অনেকের মতে, ৫ আগস্টের পর দেশে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ এসব সংস্থা ও বাহিনীকে ‘আন্ডারমাইন’ বা অবমূল্যায়নের ফলে উদ্ভূত; যে বিষয়টি সেনাপ্রধান সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কারণ ওই সব সংস্থা বা বাহিনীকে ভয় না পেলে অপরাধীরা মাথাচাড়া দেবে- এটিই স্বাভাবিক। তা ছাড়া অন্য অনেক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ার উপক্রম হলেও একমাত্র সেনাবাহিনী যে এখন পর্যন্ত ঠিক আছে, এটিও তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে তার দৃঢ়চেতা মনোভাব ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী’র ভূমিকা হিসেবেও দেখছেন বিশ্লেষকরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া

সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেকেই তার বক্তব্যের নানাদিক বিশ্লেষণ করেছেন।

মঙ্গলবার রাতে দেওয়া এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল লিখেছেন, জেনারেল ওয়াকার কথা মোটামুটি ভালোই বলেছেন। তবে তিনি সেনাপ্রধান। তার নিছক ভালো কথার কোনো দামই নেই, যদি তা ‘ব্যাক্ড বাই অ্যাকশন’ না হয়। নৈরাজ্য দূর করে দ্রুত ‘অর্ডার’ বা স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ড. ইউনূস সরকারকে আরও সহায়তা করুন।

‘প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে তাদের সবল, সক্রিয় ও সফল করুন’ উল্লেখ করে মারুফ কামাল খান আরও লেখেন, জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধানকে পপুলিস্ট হবার চাইতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় অটল দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে হবে। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে সমালোচনা হতে পারে; সংকীর্ণরা নিন্দাবাদ ও কুৎসা রটাতে পারে। কিন্তু দিন শেষে নন্দিত হবে সঠিক পথে থাকা ভূমিকাই।

মারুফ কামাল খান লেখেন, ঘাতক ফ্যাসিবাদী রেজিম অপসারণে এবং আরও প্রাণহানি এড়াতে সশস্ত্র বাহিনীর চূড়ান্ত অবস্থান সঠিক ছিল। ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রুখতেও তাদের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে। অবস্থান নিতে হবে জনগণের পক্ষে। ইউ হ্যাভ টু স্ট্যান্ড অন দ্য রাইট সাইড অব হিস্ট্রি।

এ ছাড়া একটি লেখা বেশি ভাইরাল হয়। সেটিতে উল্লেখ করা হয়- ‘দেশের প্রতি এক গভীর, চিন্তাশীল এবং সতর্কবার্তা। তার বক্তব্যের মূল উপজীব্য ছিল- দেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং একতা রক্ষা করা; যা জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যা বলেছিলেন, তা কেবল সেনাবাহিনীর বা সরকারকে উদ্দেশ করে নয়, বরং পুরো জাতির জন্য একটি মেসেজ ছিল, যেখানে শৃঙ্খলা, একতা এবং শান্তির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।’ এ ছাড়া অনেকেই কাদা ছোড়াছুড়ি না করার বক্তব্যটি শেয়ার করেছেন। বলেছেন, বক্তব্যটি সময়োপযোগী।

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক

রাজনৈতিক চিন্তক ও বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে, সেনাপ্রধানের বক্তব্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ পাওয়া যায়। তিনি দেশের বাস্তব পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেছেন। তার বক্তব্যে একধরনের পলিটিক্যাল আউটলুকও ছিল। তিনি যেসব বিষয়ে কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে এসবের বাস্তবায়ন কতটুকু হবে, তা ড. ইউনূস সাহেবের ওপর নির্ভর করছে। রাজনৈতিক বিভেদ বা হানাহানি বন্ধের কথা বলা এটি খুবই সময়োপযোগী। কারণ বিভেদ তো দেখা যাচ্ছে। তবে কোনো একটি রাজনৈতিক দলও দলীয় চরিত্র উন্নত করার চেষ্টা করছে না; এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। নির্বাচনের কথা বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তারা দেশ চালাতে পারবে কি না, এমন প্রশ্ন উঠছে।

অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, আমার কাছে খুব খারাপ কিছু মনে হয়নি। তবে অনেকে একটা পয়েন্ট ধরেছে, বিডিআর হত্যাকাণ্ড এটা সম্পূর্ণভাবে বিডিআরের ব্যাপার। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এখানে কোনো ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ (যদি ও কিন্তু) নেই। সেনাপ্রধানের পুরো বক্তব্য শুনে আমার মনে হয়েছে, উনি (সেনাপ্রধান) চাচ্ছেন আর্মড ফোর্সেস- অথাৎ আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্সে যারা আছেন তাদের দেশপ্রেম, নিষ্ঠা, সততা নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে। কারণ তার দৃষ্টিতে এই সংগঠনগুলো বাংলাদেশের অন্য সংগঠনগুলোর মতো ভেঙে পড়েনি। যেহেতু ডিসিপ্লিন আছে, সেহেতু এই সংগঠনগুলো আছে। এই সংগঠনগুলোকে যদি খাটো বা আন্ডারমাইন করা হয়, তাহলে সেটা ভালো কিছু হবে না।’ 

তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিভেদ দেশের জন্য ভালো হবে না, এটা বলা পজিটিভ। আমি নিজেও সমর্থন করি। ভেদাভেদ, চরম সংঘর্ষ, সন্ত্রাস এটা কারও জন্যই ভালো না। রাজনৈতিক বিভেদ থাকায় দুর্বৃত্তরা সুযোগ পাচ্ছে- এ কথাটা সঠিক। আরও অনেক কারণ আছে, তবে এটাও বড় কারণ। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্যে একধরনের ইতিবাচক বার্তা রয়েছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খবরের কাগজকে বলেন, ‘সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যকে আমি স্বাগত জানাই। কারণ এই সংকটময় মুহূর্তে তিনি জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন। সামরিক বাহিনী দেশে দ্রুতসময়ে একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়- এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশের সব সমস্যার সমাধান হবে- সেটাই তিনি চেয়েছেন এবং বলেছেন। সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে তিনি জাতির সামনে একটা ভালো বক্তব্য রেখেছেন।’

ফখরুল বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু প্রবলেম তো থাকবেই। এগুলো নিয়ে এত চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তার (সেনাপ্রধানের) এই বক্তব্য জাতিকে আশ্বস্ত করেছে, জাতি নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর সমর্থন পাচ্ছে একটা ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য।’

ড. শাহদীন মালিক

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্যে ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে- এটা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গতকাল খবরের কাগজকে তিনি বলেন, এমনি তো প্রধান উপদেষ্টাও ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। ফলে নির্বাচন কখন হবে, তা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি ছিল; তাই বিভ্রান্তির জায়গাটা কিছু পরিষ্কার হয়েছে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে র‌্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই- সবাই তো অপকর্মে জড়িত ছিল না, কিন্তু সবাই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যারা কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেননি, তাদের তো উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই সেটাও তিনি (সেনাপ্রধান) আশ্বস্ত করেছেন। এটা খুবই দরকার ছিল।

শাহদীন মালিক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তেমন কোনো বিভেদ নেই। তবে মতানৈক্য থাকবেই। বিএনপি আগে নির্বাচন চাইছে, জামায়াত চাইছে পরে। আবার কেউ কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চাইছে, কেউ বেশি সংস্কার করে নির্বাচন চাইছে, আবার কেউ প্রয়োজনীয় সংস্কার চায়। সংস্কারের পর নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত- এই মতবিরোধ থাকবে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, সেনাপ্রধান ডিসেম্বরের নির্বাচনের পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এটাই খুবই সময়োপযোগী এবং স্বস্তিদায়ক বক্তব্য ছিল।

তথ্যসূত্র- খবরের কাগজের সৌজন্যে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর