কুষ্টিয়ায় ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলায় মুগ্ধ দর্শক

, জাতীয়

এসএম জামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুষ্টিয়া | 2025-02-24 10:51:33

এক সময় জমিদাররা লাঠিয়াল পুষতেন তাদের সুরক্ষার জন্য। সেখান থেকেই উদ্ভব হয় লাঠি খেলার। এক সময় গ্রাম বাংলার অন্যতম আনন্দ-উৎসব ছিল এই লাঠি খেলা। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে এ খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে।

আঘাত-পাল্টা আঘাত। প্রতিপক্ষের লাঠির আক্রমণ কখনও নিজের লাঠি দিয়ে, আবার কখনও বেতের তৈরি ঢাল দিয়ে ঠেকিয়ে দিচ্ছেন চৌকস লাঠিয়ালরা। সঙ্গে ঢোল আর কাঁসরের তালে তালে নান্দনিকভাবে লাঠিয়ালদের এমন ক্রীড়া নৈপুণ্যে বুঁদ নানা বয়সী দর্শক।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রোববার বিকেলে কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত এ লাঠি খেলা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ আয়োজিত লোকনাট্য সমারোহ তিনদিন ব্যাপী এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

মিরপুর উপজেলার ছত্রগাছা এলাকার লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার আনার মোল্লার নেতৃত্বে প্রায় ৪০ জন লাঠিয়ালদের নৈপুণ্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ভিড়় করেন শিল্পকলা একাডেমির আঙ্গিনায়। তাদের ক্রীড়া নৈপুন্যে মুগ্ধ নানা বয়সী দর্শক।

এই খেলার মাধ্যমে একদিকে যেমন আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করতে পারে ভালোভাবে। তেমনিভাবে দর্শকরদেরও সহজে আনন্দ দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এসব লাঠি খেলায় শারীরিক কসরত আর ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখিয়ে আগত দর্শকদেরও নজর কাড়েন লাঠিয়ালরাও।

আক্তার হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী লাঠি খেলা দেখতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই খেলাটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। অনেকদিন বাদে কুষ্টিয়ায় লাঠি খেলা হচ্ছে এমন খবর শুনেই ছুটে এসেছি। অনেক আনন্দ পেয়েছি। তিনি বলেন, লাঠিখেলায় আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বনের প্রচেষ্টা সম্বলিত টান টান উত্তেজনাপূর্ণ ও প্রতিপক্ষকে লাঠি দিয়ে ঘায়েল করার এ যেন এক মহাযুদ্ধ। এ কৌশলটিই লাঠিখেলায় দর্শকদের প্রাণে বিনোদনের সঞ্চার করে।


আসলাম হোসেন নামে এক প্রবীন দর্শক বলেন, এই লাঠি খেলা দেখে আমার কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতি ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বিশেষ করে বাজনার তাল কানে এলেই লাঠিখেলা দেখতে ছুটে যেতাম। এখন এই লাঠিখেলার তেমন একটা প্রচলন নেই বলে আর আগের মতো মজা হয় না।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান এলাকা থেকে লাঠিখেলা দেখতে এসে ফাহিম বলেন, লাঠি খেলা দেখে আমি মুগ্ধ। তার মত বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই খেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। আমার মতে, বিদেশি মার্শাল আর্ট না শিখে, লাঠিখেলা চর্চা করলে আত্মরক্ষায় ভালো কাজ দিতে পারে।

লাঠিখেলায় অংশ নেওয়া দলনেতা শাহাদাত উল্লাহ সাদু বলেন, আমাদের দেশে নানা রকমের খেলা আছে। তবে লাঠি খেলা তার থেকে আলাদা। এই খেলায় যেমন আনন্দ পাওয়া যায়, দর্শক মাতানো যায়, আবার একইসঙ্গে আত্মরক্ষার কৌশল শেখা যায়। যদি আমরা সরকারের সহযোগিতা পেতাম তাহলে এই লাঠিখেলা অনেক দূর এগিয়ে যেতো।

লাঠিখেলার ওস্তাদ সর্দার আনার মোল্লা জানান, তারা প্রায় ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন এলাকায় লাঠিখেলা করে থাকেন। তবে এ খেলার সঙ্গে জড়িতরা প্রায় সবাই কৃষিকাজ, দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তারা দুঃখ-দৈন্যে জীবনযাপন করেন। তাদের জন্য সরকারিভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নেই। তেমন কোনো ব্যবস্থা হলে নিয়মিত চর্চা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা এ খেলাকে আরও বড় পরিসরে মানুষের সামনে তুলে ধরার দাবি জানান তিনি।

কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সুজন রহমান বলেন, লাঠি খেলোয়াড়দের সংগঠিত করতে কুষ্টিয়া শহরের পূর্ব মজমপুরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে ওস্তাদ ভাই ১৯৩৩ সালে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী নামে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী লাঠি খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণসহ এই খেলা টিকিয়ে রাখতে নানাভাবে কাজ করে চলেছে। এছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা এই লাঠিখেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে কাজ করতে চাই। বহু বছরের পুরনো এই গ্রামীণ ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতেই আমাদের এই আয়োজন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর