আলোচিত স্পর্শ কাতর ঘটনার বছর ২০১৯। অগ্নিকাণ্ড, নারী নির্যাতন ও সড়ক দুর্ঘটনা-এমন অনেক ঘটনাই দাগ কেটেছে এই বছরে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও দেশজুড়ে নারী-শিশুদের ওপর নির্যাতন থেমে থাকেনি। ঘটেছে একের পর এক লোমহর্ষক নৃশংস ঘটনা। তবে সব ঘটনাকে ছাড়িয়েছে ধর্ষণ!
২০১৯- এর শুরুতেই একদল পাষণ্ডের হাতে গণধর্ষণের শিকার হন নোয়াখালীর সুবর্ণচর গ্রামের ৩৫ বছরের এক নারী। ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাত অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ১০/১২ জন লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে বেড়া কেটে বাড়িতে প্রবেশ করেন। ওই নারীর অটোরিকশার চালক স্বামী ও চার সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তাকে গণধর্ষণ করা হয়। নির্বাচনে ভোট দেয়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার জেরে তিনি গণধর্ষণের শিকার হন।
এরপর নারীর প্রতি সূবর্ণচরের ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বছর জুড়েই দেখা যায়। কখনও ধর্ষণ, কখনও যৌন হয়রানি, কোনোদিন স্বামীর হাতে খুন- এমন ঘটনা নিয়ে বছর জুড়েই গণমাধ্যমে আসে ‘নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি’।
মহিলা পরিষদের জরিপে দেখা যায়, ২০১৯ সালে নভেম্বর পর্যন্ত নারী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ২৯০টি। এর মধ্যে দেশ জুড়ে এ বছর ধর্ষণের ঘটনা এক হাজার ৬৯৩, গণ ধর্ষণ ২২৫টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৮ জন নারী ও শিশুকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৯ জন নারী। এছাড়া নভেম্বর পর্যন্ত অন্যান্য কারণে ২ হাজার ৭৮৫ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
নারীর প্রতি নির্যাতন শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও ঘটেছে। অভিবাসী শ্রমিক হয়ে জীবিকার তাগিদ দেশ ছাড়া নারীদের ফিরে আসতে হয়েছে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থেকে নির্যাতনে টিকতে না পেরে ২০১৯ সালে দেশে ফিরেছেন ৮০০ জন নারী।
সব ঘটনা ছাপিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ড।
নুসরাত হত্যাকাণ্ড
অধ্যক্ষ সিরাজ উদদ্দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করায় ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের শরীরের ৮০% শতাংশ পুড়ে গেলে ঘটনার চার দিন পর ১০ এপ্রিল ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
নুসরাত হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হলে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
শিশু সাইমাকে ধর্ষণের পর হত্যা
জুলাই মাসের ৫ তারিখে রাজধানীর ওয়ারীতে ৭ বছরের শিশু সামিয়া আফরিন সাইমাকে ধর্ষণের পর গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে হারুন-অর-রশিদ নামে এক যুবক।
ঐদিন সন্ধ্যার দিকে সাইমার পরিবার যে ভবনটিতে থাকতেন তার ওপর তলায় খেলতে গিয়ে সায়মা নিখোঁজ হয়। পরে পরিবারের সদস্যরা অনেক খোঁজাখুঁজির পর নবনির্মিত ভবনটির নবম তলার ফাঁকা ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে সায়মার মৃতদেহ দেখতে পান।
এ ঘটনায় তার বাবা আব্দুস সালাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন। কুমিল্লার ডাবরডাঙা এলাকা থেকে প্রধান আসামি হারুনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। বর্তমানে হারুন কারাগারে রয়েছেন।
ছাদ থেকে ফেলে ২ বছরের শিশু আয়েশা হত্যা
বছরের শুরুতেই ৫ জানুয়ারি গেন্ডারিয়া থানার দিনোনাথ সেন রোডের বস্তি থেকে ২ বছরের শিশু আয়েশাকে বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এরপর তিনতলা থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে হত্যা করে জান্নাতুল ওয়াইশ নাহিদ নামে এক ব্যক্তি। ৬ জানুয়ারি নাহিদকে গ্রেফতার করা হলে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন তিনি।
ছেলে ধরা সন্দেহে বাড্ডায় নারীকে পিটিয়ে হত্যা
বছরের আরেক আলোচিত ঘটনা রেনু হত্যা। সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে খোঁজ নিতে গেলে ২০ জুলাই বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যার শিকার হয় তসলিমা বেগম রেনু (৪০)। এ ঘটনায় নিহত রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু অজ্ঞাতনামা ৪০০-৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
২৭ জুলাই আটককৃত তিন আসামি হলেন- বাচ্চু মিয়া, শাহীন ও বাপ্পী। এর আগে ২০ জুলাই ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদেরকে গ্রেফতার করেন পুলিশ।
ডেমরায় ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুই শিশু হত্যার ঘটনা
লিপস্টিক দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৭ জানুয়ারি নুশরাত জাহান (৪) ও ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) নামে দুই শিশুকে ঘরে ডেকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে, পরে তাদের হত্যা করেন সিরামিক কারখানার শ্রমিক গোলাম মোস্তফা (৩০) ও বেকারি শ্রমিক আজিজুল ইসলাম (২৮) নামের দুই যুবক।
চলন্ত বাসে নার্সকে ধর্ষণের পর হত্যা ঘটনা
৬ মে রাতে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর গামী স্বর্ণলতা নামে চলন্ত বাসে শাহিনুর আক্তার তানিয়া (২৫) নামের এক নার্সকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ঐদিন রাতে তানিয়া ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন এসময় কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ডে অন্যান্য যাত্রীরা নেমে যান। এরপর বাসচালক নুরুজ্জামান, হেল্পার লালন মিয়া ও চালকের খালাতো ভাই বোরহানউদ্দিন ওই নারীকে ধর্ষণের পর বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। এ সময় মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ডাক্তার মৃত বলে ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় বোরহান উদ্দিন, স্বর্ণলতা পরিবহনের এমডি পারভেজ সরকার ও টিকিট বিক্রেতা আল আমিন এখনো পলাতক আছেন। বাকি ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়।
সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার নাজমার মৃত্যু
সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে মো. সিদ্দিক নামের এক দালালের মাধ্যমে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে কাজের সন্ধানে সৌদি আরবে যান মানিকগঞ্জের নাজমা বেগম (৪০)। ১০ মাসের মাথায় সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ অমানুষিক নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুর দু'দিন আগেও নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বজনদের কাছে কাকুতি মিনতি করেন নাজমা। কিন্তু অর্থাভাবে তাকে দেশে ফিরে আনা সম্ভব হয়নি অসহায় পরিবারের। মৃত্যুর ১ মাস ২৪ দিন পর ২৪ অক্টোবর রাতে দেশে আসে নাজমা বেগমের মরদেহ।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের বিষয়ে মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ফওজিয়া মোসলেম বার্তা২৪.কমকে বলেন, নারী সহিংসতার ঘটনাগুলো সত্যিই দুঃখজনক, বিব্রতকর সেই সাথে উদ্বেগজনক। যা একটি স্বাধীন দেশে ভাবা যায় না। এতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং এর পর হত্যা করা হয়েছে যা একটি সভ্য দেশের পরিসংখ্যান হতে পারে না।
নারী ও শিশু নির্যাতনে দমনে আইনি পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, প্রথমেই ঘটনাগুলোর বিচার হওয়া জরুরি। সে দিক থেকে নুসরাতের ঘটনাটা জোর গলায় বলা হয় বিচার হয়েছে। এতগুলো ঘটনার মধ্যে মাত্র একটির বিচার হয়েছে। এটা কি এত ফলাও করে বলার কিছু আছে? তবে নুসরাতের ঘটনার বিচার হওয়ায় এটা পরিষ্কার যে বিচার করতে চাইলে বিচার করা যায়। এটাকে প্রতীকী বিচার বলা যেতে পারে। কারণ এতগুলোর মধ্যে মাত্র একটি ঘটনার বিচার হয়েছে। তাই বলছি প্রতীকী বিচার না হয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক এবং ন্যায়সঙ্গত ভাবে প্রত্যেকটি ধর্ষণের বিচার হওয়া উচিত।
তিনি আরো বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে মাদকের একটি বড় ভূমিকা আছে। আমরা বলছি 'মাদককে না বলুন' কিন্তু আমরা তো জানি মাদক ব্যবসার যে সিন্ডিকেট আছে তা কত শক্তিশালী। কিন্তু এই মাদক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়া বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা এর ফলে মানুষ মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়। তাই বেকারত্ব দূর করতে হবে। সেই সাথে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার খেলাও বন্ধ করতে হবে।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বলেন,যখন একটি নারী আক্রান্ত হয় তখন আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তার কারণে সমাজ পাশে দাড়ায় না। এসবের জন্য সমাজ এবং পরিবার নারীর বেশভূষা কে চলাফেরা কে দায়ী করে। এক্ষেত্রে তনু আর নুসরাতের উদাহরণ যদি দিয়ে বলতে হয়,তারা দুজনই হিজাবধারী সুন্দর বেশভূষা নিয়ে বের হতেন তবে কেন তাদের সাথে এই সহিংসতা হলো? তাই ধর্ষণ হলে যে মেয়েকে দায়ী করা হয় এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে বের করে আনতে হবে। সেইসাথে অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
শিশু ধর্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বছর নতুন একটি প্রবণতা খুব বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেটি হচ্ছে শিশু ধর্ষণ। আগে স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়েদেরকে বা ইয়াং মেয়েদেরকে ধর্ষণ হতে দেখা যেত বেশি। তাই শিশু ধর্ষণের বিষয়গুলোকে আমরা এলার্মিং হিসেবে ধরতে পারি। তাই বলছি ধর্ষণের ক্ষেত্রে এখন আর কোনো বয়স ফ্যাক্ট নয়। ৯ মাসের শিশুর ধর্ষিত হচ্ছে আবার ৮০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শরীরে বিভিন্ন ব্যাধি যেমন বাসা বাঁধে তেমনি সমাজে ধর্ষণ ব্যাধি হিসেবে বাসা বেঁধেছে।