ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ তাণ্ডব চালিয়েছে দেশে। ভয়াবহ এই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মৃতের চূড়ান্ত পরিসংখ্যান না মিললেও এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে এ সংখ্যা ১০।
ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঘরবাড়ি ছাড়া অগণন। কেবল মানুষই নন, ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য সম্পদ, গবাদি পশুও। এই ঘূর্ণিঝড়ে সম্পদ ও মৃত মানুষের সংখ্যা গোনা হবে কিন্তু গোনা হবে না সেই পশুপাখির সংখ্যা।
মানবিক দৃষ্টিতে মানুষ ছাড়াও অন্য প্রাণের কথা বলছি ঠিক, তবে এটা সম্ভব হবে না। অবশ্য ওই পথে যাবেনও না কেউ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবপ্রাণ-সম্পদের পাশাপাশি অগণন প্রাণের ক্ষয় হয়। সেদিকে দৃষ্টিও দেওয়া হয় কম। এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়েছি আমরা।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রথম আঘাত আসে সুন্দরবনে। বাংলাদেশের ফুসফুস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবন প্রতিবারই প্রাথমিক আঘাত সামলায় প্রকৃতির। নিজে লণ্ডভণ্ড হয়ে বাঁচিয়ে দেয় উপকূলীয় এলাকাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সিডর, আইলাসহ আরো অনেক দুর্যোগের মতো এবারও ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্লাবিত হয়েছে সুন্দরবন।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও ৩০ ঘণ্টাব্যাপী জলমগ্ন থাকায় বিশাল ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০টি হরিণের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে, আরো কয়েকটি হরিণ। বনের মধ্যে থাকা ৮০টি পুকুরে লবণ পানি ঢোকায় মিষ্টি পানির উৎস নষ্ট হয়ে গেছে।
এখানে হয়ত বাঘ ও হরিণের সংখ্যাই আমাদের চোখে পড়বে। এর বাইরে আরো অসংখ্য প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে সুন্দরবনে। তারা গুণতিতে আসলেও আলোচনায় আসবে না।
বনজ সম্পদ ও বন্যপ্রাণীর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানতে বন বিভাগের সদস্যরা সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বন ও সাগরের প্রতিকূল যে অবস্থা, তাতে এই পরিদর্শন এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনই নির্ণয় সম্ভব হবে না। সময় লাগবে এর। প্রাণ ও সম্পদের এই ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় কাগজে-কলমে হলেও এই ক্ষতি কিন্তু পূরণীয় নয়।
সুন্দরবনে ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করতে বন বিভাগ কাজ করবে কিন্তু উপকূলের মানুষজনের যে ক্ষয়ক্ষতি, সেটা নির্ধারণ হবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাঠপ্রশাসনের দায়িত্বশীলদের অনুমানে ভিত্তিতে। ফলে, বাস্তবতা আর কাগজের মধ্যে থেকে যাবে বিস্তর ব্যবধান। প্রাণপ্রকৃতির ক্ষতির পাশাপাশি এটাও অপূরণীয় এবং একান্তই ব্যক্তিগত অর্থাৎ যার গেছে, তারই কেবল গেছে!
সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় যা কিছু দেওয়া হবে, সেটা স্রেফ স্মারক সাহায্য হিসেবে থেকে যাবে। এধরনের সাহায্য-সহযোগিতা এমনই হয়ে থাকে। তবে মানুষকেই এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আগেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপক্ষে জীবনসংগ্রামের লড়ার যে দুরন্ত অভিজ্ঞতা আর সাহস, এখানেও পথ দেখাবে তাদের।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্কয়ী ঘূর্ণিঝড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং কোটি মানুষ সব হারালেও সেই উপকূলের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। মোকাবিলা করেছেন ‘নার্গিস’, ‘মহাসেন’, ‘বিজলি’, ‘মোরা’, ‘রোয়ানু’, ‘মিধিলি’, ‘মোখা’, ‘আমফান’, ‘ফনি’, ‘সিত্রাং’, ‘বুলবুল’, ‘সিডর’, ‘আইলা’, ‘রিমাল’সহ নানা নামের ছোটবড় নানা দুর্যোগকে।
প্রতিবারই ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, জলোচ্ছ্বাস হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ, প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রকৃতির এ ধারা চলতেই থাকবে। কখনো ছোট আবার কখনো বা বড় দুর্যোগ আঘাত হানবে। এটাই ভবিতব্য। এটাকে যখন খণ্ডনের সুযোগ নেই, তখনও সুযোগ আছে মোকাবিলার। মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সেটা মোকাবিলা করে আসছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সহায়তা করছে। এই সহায়তার বাইরে জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচাতে যে বেড়িবাঁধের কথা বলা হয়, সেটা কি পুরোপুরি হচ্ছে আদৌ!
বিভিন্ন মাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, এখনো অনেক বেড়িবাঁধ অরক্ষিত। অনেক জায়গায় সরকারি বরাদ্দ থাকলেও কাজ হয় না ঠিকমতো। ‘রিমাল’ ঘূর্ণিঝড়ের খবরে স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ মেরামত করেছেন এবারও। উপকূলবাসীকে বাঁচাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ কাজগুলো করা উচিত। এটা দেশের অন্য যেকোনো মেগা প্রকল্পের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বলা যায়, সবচেয়ে জরুরি এটা! কারণ, এখানে মানুষের বেঁচে থাকা আর জীবনমরণের প্রশ্ন!
দেশের একদিকে যেমন তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’, অন্যদিকে কিছু লোক সামাজিক মাধ্যমে ব্যস্ত ‘ভিউ ব্যবসায়’। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ছবি প্রবল আবেগে ভাসিয়েছে সবাইকে। যে ছবিতে দেখা যায়, কর্দমাক্ত স্থানে এক মা তার সন্তানকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন। ছবিটি এবারের ঘূর্ণিঝড়ের বলে দাবি করা হয়। অথচ এই ছবিটি ভুয়া। বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান ‘রিউমার স্ক্যানার’ জানিয়েছে, মা ও তার সন্তানকে আগলে রাখার এই ছবিটি সঠিক নয়। এটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
বার্তা২৪.কমকে ছবিটি যে অসত্য, তা নিশ্চিত করেছেন ‘রিউমার স্ক্যানার’-এর হেড অব অপারেশনস সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী।
প্রতিষ্ঠানটির অনুসন্ধানে জানানো হয়, ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’-এর তাণ্ডবে ভোলার চরফ্যাশনে কর্দমাক্ত স্থানে মা ও সন্তানের দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি বাস্তব নয়। ছবিটি গত মার্চ মাস থেকেই ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে, যা এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি।
যে বা যারা ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স-সহ নানান মাধ্যমে ছড়িয়েছেন নিশ্চিতভাবেই তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। সামাজিক মাধ্যমের ‘ভিউ ব্যবসার’ কারণে মানুষের আবেগ নিয়ে খেলেছেন। এখানে তাদের প্রাপ্তির জায়গা হলো কিছু ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ ও ‘শেয়ার’।
সামাজিকমাধ্যম থেকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ যেখানে রয়েছে, সেখানে তারা এই মানুষের আবেগ ও সমবেদনাকে পুঁজি করে নিজেরা কিছু কামাই করতে চেয়েছেন। এটা অনৈতিক চেষ্টা তাদের। মানুষ যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে লড়ছেন, সেখানে তারা মানুষের অসহায়ত্বকে উপলক্ষ করে মানবিকতার নামে অনৈতিক চর্চা করছেন।
রিউমার স্ক্যানার নামের প্রতিষ্ঠানটি ফ্যাক্ট চেক করায়, এখন ছবির অসঙ্গতিগুলো নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই। দোষারোপ করছেন যারা ছবিটি প্রচার করছেন তাদের। এই প্রচারকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই হয়ত সরল বিশ্বাসে প্রবল আবেগে আলোড়িত হয়েছিলেন। দুর্যোগেও মানবিকতাকে নিয়ে ব্যবসা করার যে কূটচিন্তা যাদের মাথা থেকে এসেছে, তারা সঠিক কাজ করেননি। এটা অন্যায় হয়েছে তাদের। এই ছবি দিয়ে হয়ত বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি কারো কিন্তু এর দ্বারা মানুষের সরল বিশ্বাস, আবেগকে নিয়ে খেলা করা হয়েছে। এ বিষয়টির আইনি প্রতিবিধান থাকলে সেটা অনুসরণ করা উচিত হবে।
ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’-এর আঘাতে প্রাণপ্রকৃতি ও সম্পদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা অপূরণীয় হলেও ক্রমে সবকিছু ফিরবে স্বাভাবিক নিয়মে, স্বভাব ছন্দে। এই সময়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ মোকাবিলা করেছে যে, প্রাণপ্রকৃতি, তাদের মধ্যে রয়েছে টিকে থাকার অফুরন্ত শক্তি। দুর্যোগ-পরবর্তী এই পর্বেও তারা বিজয়ী হবে নিশ্চিত।
কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম